ঢং…….. ঢং……….. ঢং…………….। টিনের চালের একটানা ছন্দময় রিমঝিম শব্দ ভেদ করে বহুদূরের গির্জার ঘন্টাটি তার মাদকতাময় ধ্বনি ছড়িয়ে দিল চারিদিকে। ব্যস্ত হাতগুলো মুহূর্তে থেমে গেল। গলা স্পর্শ করলো আঙ্গুলগুলো…….. স্পর্শ নিচ্ছে মঙ্গল সূত্রের। জায়গাটা একদিন ছিল শুধুই ক্রুশবিদ্ধ যীশু খ্রীষ্টের! চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো শ্রাবন্তীর। আবার নষ্টালজিয়া তাড়া করেছে তাকে।
ছেলে বেলাটা ছিল অন্যরকম। প্রতি রবিবারই যেন এক একটি বড়দিন। গির্জায় ঘন্টা বাজলেই সবচাইতে প্রিয় ফ্রকটা পড়ে গির্জায় ছুটে যেত শ্রাবন্তী। গির্জায় পৌছে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়াতো। সিড়ির পর সিড়ি, বিশাল দরজা, উপরে মা-মারীায়ার মূর্তি, ভিতরে সারি সারি বেঞ্চ! বাইরে গাছগুলো ঝিরঝির বাতাস দিচ্ছে। এত শান্তি! এই সাজানো গোছানো পরিবেশে যে শান্তি, তা আর কোথাও পাওয়া যায় কিনা শ্রাবন্তী জানতো না।
“আজি শুভদিনে পিতার ভবনে
অমৃত সদনে চল যাই।”
গানটা গাইতো সে মোহাবিষ্টের ন্যায়। হৃদয়ে ভাসতো এমন একজন পিতার মুখ-যার অবয়ব দিতে শ্রাবন্তী নিজেই ব্যর্থ হতো। লম্বা ক্যাসাক পড়া সৌম্য চেহারার ফাদারের বাণী তার এত ভাল লাগতো যে বলার নয়। একদিন উপদেশে ফাদার যখন যীশুর যাতনাভোগের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল শ্রাবন্তী। অন্য মেয়েরা তাই দেখে খুব হেসেছিল। ফাদার অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটির অবুঝ কান্না দেখে! খ্রীষ্টযাগের পরে ফাদার তাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, “বড় হয়ে যীশুর জন্য কাজ করবে তুমি”। শ্রাবন্তীর সেদিন কি যে ভাল লেগেছিল! আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পাচ্ছিল কাঁটার মুকুট পড়া যীশুর বেদনার্ত মুখ!
তারপরে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা দিয়েছে শ্রাবন্তী। গির্জায় যাওয়াটা নেশার মত হয়ে দাঁড়ায় তার। আরেকটা অদ্ভুত শখ ছিল শ্রাবন্তীর! খ্রীষ্টযাগ শেষ হলেই হেঁটে বেড়াতো কবরস্থানে। মনযোগ দিয়ে পড়তো এপিটাফের লেখাগুলো। প্রতিটি এপিটাফের প্রতিটি কথা ছিল তার মুখস্থ। তার মনে সর্বদাই ছিল সেই স্বপ্ন- যীশুর জন্য কাজ করবে সে, বড় হয়ে সিস্টার হবে।
দিন কেটে যায়। যৌবনে পা রাখে শ্রাবন্তী। একদিন পুকুর থেকে পানি নিয়ে ফেরার পথে সুমন নামের ছেলেটি হঠাৎ করে একটুকরো কাগজ ধরিয়ে দেয় তাকে। উপরে টকটকে লাল একটা গোলাপ ফুল আঁটা স্কচটেপ দিয়ে। সে ভয়ে কেঁপে ওঠে। ভেবে পায়না কি করবে। শেষে জয় হলো কৌতুহলের! বাড়ীতে ফিরে চিঠি পড়ে অবাক হয়ে যায় শ্রাবন্তী। এত সুন্দর করে কেউ লিখতে পারে! প্রবল ঝড় ওঠে হৃদয়ে। সে কি করবে? শ্রাবন্তী ভাবে, ‘আমার এসবকে প্রশ্রয় দেয়া চলে না। আমি না সেই কবে যীশুর কাছে নিজেকে দান করেছি’। কিন্তু ভাবনায় জোড় পায়না সে। চিঠির অক্ষর গুলো ক্রমশ দূর্বল করে তোলে তাকে। ছল ছল চোখে সে তাকায় রক্ত লাল গোলাপ ফুলটার দিকে। যীশুর রক্ত কি আরো বেশী লাল!
সুমনের সাথে শ্রাবন্তীর সম্পর্কের কথা এক সময় জেনে যায় তার মা-বাবা। প্রচণ্ড বকাবকি করে তারা শ্রাবন্তীকে। সুমনকে ভুলে যেতে হবে, কারণ সে হিন্দু। একদিকে মা-বাবা আরেকদিকে সুমন। অন্তর্দ্বন্ধ রক্তাক্ত করে তোলে শ্রাবন্তীর হৃদয়কে। সে বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে।
একদিন সকালে শ্রাবন্তীকে আর পাওয়া গেলনা। সুমনের কাছে ধরা দিয়ে সব যুক্তি, সব সঙ্কল্প তুচ্ছ করে আবেগের উচ্ছ্বলতায় গলার ক্রুশখানি একটানে ছিড়ে ফেলে শ্রাবন্তী! সুমনের চোখদুটো কেমন যেন জ্বলে ওঠে! আগুনের চারধারে সাতপাক ঘুরে মন্ত্র উচ্চারণ আর অন্যান্য সামাজিকতা শেষ হলো। গলায় মঙ্গল সূত্র, সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে উঠলো লাল টিপ! নতুন বেশে কেঁপে উঠলো শ্রাবন্তী। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, চোখের দৃষ্টি ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে উঠছে!
অনেক বছর পরে ছোট্ট বেলার সেই ফাদারের সাথে পথে দেখা হলো শ্রাবন্তীর। তার নতুন বেশ দেখে অবাক হলেন তিনি। প্রণাম করলো শ্রাবন্তী। ফাদার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তার চোখে কোন ঘৃণা নেই, রাগ নেই! আছে শুধু কেমন একটু অবিশ্বাস! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করলো শ্রাবন্তীর! খুব বলতে ইচ্ছা করলো, “ফাদার, যে শ্রাবন্তীকে আপনি চিনতেন, আমিতো আর সে শ্রাবন্তী নেই। আমি কেবল তার এপিটাফ।” কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি সে। দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল শ্রাবন্তী!
“শ্রাবন্তী! কি করছো তুমি? রুটি যে পুড়ে যাচ্ছে।”- সুমনের রাগত কন্ঠে বাস্তবে ফিরে এলো শ্রাবন্তী। চোখের পানি মুছে হাতদুটো আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলো রুটি বানাতে।