অফিসের ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না লিমন। “জীবনটা সমঝোতার, প্রতিবাদের নয়!”- কি ঠাণ্ডা মাথায়ই না কথাগুলো বলে দিলেন এমডি সাহেব। তাই বলে চোখ বন্ধ করে ভেজাল ওষুধ বানানো হবে, আর সে সব জেনেও চুপ করে থাকবে! এ অসম্ভব ব্যাপার। কাউকে বলে কিছু লাভও নেই। কেউ আজকাল এসব নিয়ে মাথা ঘামায়না। রতন সাহেবকে এমডি’র সাথে তার আলাপের কথা বলতেই সে এমন হো হো করে হেসে উঠলো যেন সে একটা বাচ্চা ছেলের মত কাজ করেছে।
তবে তার কলিগ জয়ন্ত একটু আলাদা। সে যখন তার সেন্টিমেন্ট, ঘটনা ইত্যাদির কথা জয়ন্তকে জানাচ্ছিল, সে তখন চুপ করে খুব মনযোগের সাথে তার কথা শুনছিলো। সব শুনেও তার কোন মন্তব্য নেই, কোন ঠাট্টা নেই। সচরাচর এমনটা দেখা যায়না। তবে মানুষটাকে ঠিক বুঝতে পারেনা লিমন। কেমন যেন অদ্ভুত ঠাণ্ডা স্বভাবের। কারো সাথে বেশী একটা কথা বলেনা। চোখের দিকে তাকালে, বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। অফিসের কাজে দুবার ওর ঘরে গিয়েছিল লিমন। দামী সব আসবাবে সাজানো। সে আর জয়ন্ত একই স্কেলে বেতন পায়। তার মাস শেষে টানাটানি শুরু হয়ে যায়, আর জয়ন্ত ……….. । কিন্তু জয়ন্ত ঘুষ খায়, দু নম্বরী করে- তার কোন শত্রুও একথা বলতে পারবে না। আলাদা কোন ব্যবসা করে বলেও তো শোনেনি। ধ্যাত্তোরি! ….. থাকুক যে যার মত। টেবিলে ফিরে গেল লিমন। চিঠিটা লেখা শেষ। স্বাক্ষর করে খামে ভরলো। ঠিকানাটাও লিখলো….. সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। কালকেই পৌঁছাতে হবে। এভাবে হাজার হাজার মানুষের ক্ষতি হতে দেয়া যায়না। উঠে দেয়ালের ছবিটার সামনে গেল লিমন। সুলেখা, সে আর বাবু। মাত্র দুমাস আগে তোলা হয়েছে। “আর মাত্র কটা দিন কষ্ট করো সুলেখা, সামনের মাসেই তোমাদের ঢাকা নিয়ে আসবো।” মৃদু হেসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল লিমন।
রাত ১২.০০ টা। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এখনই বের হতে হবে। ঝিগাতলা অনেকটা পথ। গামবুট আর পা ঢাকা রেইন কোট পড়ে রাস্তায় বের হয়ে এলো। বের হতেই রিক্সা পাওয়া গেল। ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন বলতে হয়। এই রিক্সা দাঁড়াও। মাথায় হুড টেনে নিয়ে রিক্সায় চড়ে বসলো লোকটা। এরকম বৃষ্টিতে মনটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। মুষলধারে বৃষ্টি হলেই সে আর তার ‘লেখা’ বৃষ্টিতে হাত ধরে ভিজতো। সেই লেখা ……….! তার সাথে একসাথে এত সময় কাটিয়েও তাকে চিনলোনা। ভালবাসি বলতে গিয়ে শুনলো, লেখা ভালবাসে অন্য কাউকে। প্রথম ভালবাসা, শেষও। তার পাথর হৃদয়টা একবারই মাত্র গলেছিল। “উহ্, রাস্তার যা অবস্থা, সোজা হয়ে বসবারও জো নেই”- রিক্সার ঝাঁকুনিতে বাস্তবে ফিরে গলির মুখে রিক্সা থামালো। রিক্সাটা অদৃশ্য হতেই লোকটা যে পথে এসেছে সেই পথেই কিছুদূর গিয়ে একটা গলিতে ঢুকলো। ১০১/২ নং বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে পর পর তিনবার নক করলো।
হাই তুলে জেগে উঠলো লিমন। বালিশের পাশে রাখা রেডিয়াম ডায়াল হাত ঘড়িতে তখন রাত ১.১৫ টা। এত রাতে দরজা নক করছে কে? বাড়ী থেকে কোন দুঃসংবাদ আসেনি তো? বুকের ভেতরটা দুশ্চিন্তায় খামছে ধরছে। আরো তিনবার নক। লাইট জ্বেলে দরজা খুলতেই পরিচিত লোকটা ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। অবাক হলো লিমন। “আপনি এতরাতে আমার বাড়ীতে। প্রথম বার আসলেন একেবারে হঠাৎ করে! কোন দুঃসংবাদ নেই তো?
আগন্তুকের হাতের দিকে তাকাতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল লিমনের। দুপ করে একটা ভোঁতা শব্দ হলো সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল থেকে। নিংশব্দে মাটিতে পড়ে গেল লিমন অবিশ্বাস মেশানো দৃষ্টি নিয়ে। দু’একবার ছটফটিয়ে একেবারে স্থির! লাশটাকে ডিঙ্গিয়ে টেবিল থেকে একটা খাম তুলে নিয়ে টয়লেটে ঢুকলো আগন্তুক। প্যাকেট থেকে একটা বেনসন সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝোলালো। লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো, আগুন লাগালো খামটায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সচিবের কাছে কোনদিনই আর তা পৌঁছবে না। কাগজ পোড়া ছাইগুলো পড়তে লাগলো কমোডে। আগন্তুক ফ্ল্যাশ টেনে দিল একটু পরে।
টেলিফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। শাওয়ার শেষে বেরিয়ে টেলিফোন ধরলো জয়ন্ত।
– হ্যালো জয়ন্ত বাবু, একটা দুঃসংবাদ আছে।
– বলুন ম্যানেজার সাহেব।
– লিমন সাহেব খুন হয়েছেন।
– সে কি, কখন?
– কাল রাতে। আমি তার বাসায় যাচ্ছি।
– আচ্ছা আমিও আসছি।
লিমনের বাসায় পৌঁছে জয়ন্ত দেখে ডেডবডি পুলিশের গাড়ীতে ওঠানো হয়েছে। ম্যানেজার সাহেবও সাথে যাচ্ছেন। কৌতুহলী হয়ে ঘরে ঢুকলো জয়ন্ত। দেয়ালের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো জয়ন্ত। লিমন, সম্ভবত তার স্ত্রী এবং সন্তানের বাঁধানো ছবি। সুলেখা ………………, সেই সুলেখা ………। সুলেখা লিমনকে বিয়ে করেছে! জয়ন্তর মাথাটা ঘুরে উঠলো। অনেক দেরী হয়ে গেছে, বড় বেশী দেরী। আরো আগে জানা উচিত ছিল। ক্রস্ত পায়ে বের হয়ে এলো জয়ন্ত। একেবারে বিধ্বস্ত।
সুলেখা বাবুকে কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসা। বা হাতে কম্পিউটার টাইপ করা একটা চিঠি আর ৩,০০০.০০ টাকা। অবাক হয়ে ভাবছে সুলেখা। লিমনের এক কলিগ ৩,০০০.০০ টাকা পাঠিয়েছে। অপরিচিত কারো কাছ থেকে সাহায্য নেয়াটা সুলেখার জন্য অপমানজনক। কিন্তু লিমন মারা যাওয়ার পরে গত তিনমাস সংসার চলছে প্রচণ্ড টানাটানিতে। সংসার চালানোই কষ্টকর। আবার বাবুর স্কুল খরচ, ঘরে অসুস্থ শ্বাশুরী ……………..। অবশ্য লোকটা লিখেছে, সে লিমনের কলিগ, বন্ধুর মত। নামটা লিখলে ভাল হতো, অন্তত একবার ধন্যবাদ জানানো যেত।
কোম্পানীর লিগ্যাল অফিসারের ঘরটা ফাইলের স্তুপে ঠাসা, এলোমেলো। গোছানোর কোন চেষ্টাই কখনো করা হয়নি। বিরক্তির সাথে রুমে ঢুকলো জয়ন্ত। কপাল কুঁচকে আছে। টেবিলের ফাইল থেকে চোখ ওঠালো উকিল সাহেব।
– আরে জয়ন্ত বাবু। বসুন, বসুন।
– এর মধ্যে কাজ করেন কিভাবে?
– কাজের জন্যই তো ছড়ানো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেজে-গোবরে না হলে উকিল বাবুরা বাঁচবে কিভাবে বলুন?
– উকিল সাহেব, আমার কাজটা কি হয়েছে?
– একদম। এবার আপনার আর দুজন সাক্ষীর স্বাক্ষর হলেই হলো।
– অনেক ধন্যবাদ।
– জয়ন্ত বাবু, একটা প্রশ্ন করি? লিমন বাবু বা তার স্ত্রী কি কোনভাবে আপনার আত্মীয় না কি?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– স্বাভাবিক। আপনি লিমন বাবুর ছেলের নামে এতগুলো টাকার Fixed Deposit দানপত্র করে দিচ্ছেন ……
– উকিল সাহেব, আপনার কি মনে হয়- আরো কেউ এই প্রশ্ন করতে পারে?
– ইয়ে না মানে দুঃখিত! ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে।
– সময়মত দানপত্রটা পাঠিয়ে দেবেন।
– অবশ্যই, অবশ্যই। কাল বিকেলের মধ্যেই ওরা তা পাবে।
– ধন্যবাদ উকিল সাহেব। একটা কথা- “ভালবাসার চ্যালেঞ্জটা নেয়া বড় কঠিন!” চলি।
লিগ্যাল অফিসার জয়ন্তর গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা অদ্ভুত! চোখের চাউনীটা বুকের ভেতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। আবার পাগলামীও আছে। নতুবা এমন বোকার মত কাজ করে কেউ।
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যা ৬.৪৫টা বাজে। ব্যালকনির চেয়ারে বাতি নিভিয়ে বসে আছে জয়ন্ত। বৃষ্টিতে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গেছে। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বান ডেকেছে দু’চোখ। “ভাল থেকো সুলেখা। এমন প্রতিশোধ কখনোই নিতে চাইনি আমি। যে ভালবাসে সে কখনো প্রতিশোধ নিতে পারেনা।” ঢং ঢং করে রাত ১২ টার ঘন্টা বাজলো দূরের গির্জায়। বৃষ্টির প্রকোপ যেন একটু কমে এলো। আকাশের এ মাথা ও মাথা চিরে দিয়ে বিজলী চমকালো। দু’লাইনের চিরকুটটা পড়ে আছে ব্যালকনির কোনায় পানিতে। জয়ন্তর ডান হাতের আঙ্গুলগুলো থেকে টবে রাখা গাছের সাথে নিশ্চিন্তে জাল বুনছে ছোট্ট একটা মাকরশা। মুহূর্তে কর কর শব্দে বাজ পড়লো। নতুন উদ্যমে শুরু হলো আকাশের কান্না।