খ্রীষ্টের মৃত্যুতে তাঁর শিষ্যেরা, প্রিয়জনেরা যখন হতাশায় মুষড়ে পড়েছে, পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট তখন দেখা দিলেন নিজ সমাধিগুহার বাইরেই। “এঁদের নাম মাগদালার মারীয়া, যোহানা আর যাকোবের মা মারীয়া।” (লূক ২৪:১০) যীশু মারীয়াকে ক্রন্দসসিক্ত, ব্যথাতুর দেখে বললেন, “মা,কাঁদছ কেন? কাকে তুমি খুঁজছ?” (যোহন ২০:১৫) নিজের পুনরুত্থানের গৌরবময় সত্যের প্রথম প্রকাশ! “কাঁদছ কেন?”- কান্নার দিন শেষ; তিনি এখন পুনরুত্থিত! “কাকে খুঁজছ তুমি?”- তিনি তো আর মৃতদের মধ্যে নেই। “তিনি মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন।” (মথি ২৮:৭)যীশুর এই আত্মপ্রকাশ শুধু নিজের পুনরুত্থানের প্রমাণ দান নয়; বরং প্রিয়জনের হতাশা মুছে দিয়ে আশার বীজ বোনার প্রচেষ্টা। হতাশা, দুঃখ, কষ্ট ভারাক্রান্ত জীবনে পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট আমাদের নব আশা, আনন্দের উৎস।
ভারাক্রান্ত নারীদের হতাশা দূর করেই তিনি ক্ষান্ত হলেননা, দায়িত্বও দিলেন, “আমার ভাইদের কাছে যাও, তাদের গিয়ে বল;” (যোহন ২০:১৭) “তাঁরা তখন ভয় মেশানো গভীর আনন্দ নিয়ে তাড়াতাড়ি সমাধিস্থান ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁরা ছুটে চললেন যীশুর শিষ্যদের কাছে এই সংবাদ জানাতে।” (মথি ২৮:৮)
আমাদের হৃদয়ে খ্রীষ্টের পুনরুত্থান তাই শুধু আনন্দ ঘন্টাই বাজায়না, বরং বিশ্বাসী ভাই-বোনদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালনের আহ্বানও জানায়। পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট তাই বাণী প্রচারের আহ্বান!
এম্মাউস গ্রামে যাচ্ছিলেন ক্লেওপাস অপর একজন শিষ্যকে নিয়ে ম্লান মুখে, বিষন্ন হৃদয়ে। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন যীশুর জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়াবলী নিয়ে। “এমন সময় যীশু নিজেই হঠাৎ পেছন থেকে এসে তাদের সঙ্গে পথ চলতে লাগলেন। তবে তাদের চোখ তাঁকে চিনতে কেমন যেন বাধা পেল।” (লূক ২৪: ১৫, ১৬) যীশু জানতে চাইলেন তাদের আলোচনার বিষয় কি? তারা বলে যেতে থাকলেন, কোন বাধা না দিয়েই যীশু শুনতে লাগলেন। তারা যীশুর প্রাবক্তিক শক্তির সাক্ষ্য দিতে লাগলেন।
ব্যক্তি জীবনে আমরা যখন হতাশার পথ চলি, সে যাত্রাও এম্মাউস যাত্রার মত। আমরা চিনতে না পারলেও সহযাত্রীরূপে খ্রীষ্ট থাকেন আমাদের সহযাত্রী হয়ে। তিনি পথ চলেন ও আমাদের কথা শোনেন। পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট তাই আমার হতাশার জীবনে সহযাত্রী ও সহভাগিতার মানুষ।
এম্মাউস যাত্রী শিষ্যেরা যখন যীশুকে চিনতেই পারছিলেন না, “তখন মোশী থেকে শুরু করে যত প্রবক্তার কথা উল্লেখ করে তিনি, শাস্ত্রে তাঁর সম্বন্ধে যেখানে যা কিছু বলা হয়েছে, তার অর্থ তাদের বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।” (লূক ২৪:২৭) তাঁর কথা ভাল লাগায় তারা তাঁকে তাদের সাথে থাকার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমরা যখন যীশুকে চিনতে পারিনা, তখন বিভিন্ন উপায়ে তিনি আমাদের বোঝানোর চেষ্ঠা করেন ও আমরা তাঁকে হৃদয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাই। পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট আমাদের চোখ খুলে দিয়ে বোধ জাগ্রত করেন ও আমাদের সাথে থাকেন।
ভেতরে গিয়ে “তিনি তাদের সাথে খেতে বসেছেন, এমন সময়ে একখানা রুটি হাতে নিয়ে তিনি পরমেশ্বরকে স্তুতি ও ধন্যবাদ জানালেন; তারপরে সেই রুটিখানি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তাদের হাতে দিলেন। তখন তাদের দৃষ্টি যেন খুলে গেল: তারা এতক্ষণে তাঁকে চিনতে পারলেন।” (লূক ২৪: ৩০-৩১)
দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কারণে আমরা দূরে সরে যাই জীবন্ত খ্রীষ্ট থেকে। তাঁকে চিনে নিতে আমাদের মন যেন বাধা পায়! কিন্তু খ্রীষ্টযাগে আমাদের মনের চোখ খুলে দিয়ে তিনি আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করেন। খ্রীষ্টযাগের মাধ্যমে তাঁর সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট আমাদের আহ্বান জানান।
যীশুর দর্শন পেয়ে, তাঁকে চিনতে পেরে “তারা সেই মুহূর্তেই পথে পা বাড়ালেন; জেরুসালেমে ফিরে এলেন তারা।” (লূক ২৪: ৩৩) যে হতাশা নিয়ে চলতে চলতে তারা এম্মাউসে গিয়ে পৌঁছেছিল, সে হতাশা যেন হঠাৎ উবে গেল! তার পরিবর্তে নব আশা নিয়ে তারা জেরুশালেমে ফিরে এলো। পুনরুত্থিত খ্রীষ্টকে লাভ, তাঁর দর্শন আমাদেরকেও হতাশার ভুল পথ থেকে আশার পথে ফিরিয়ে আনে, চ্যালেঞ্জ থেকে পালানোর অদম্য আকাঙ্খা থেকে উদ্ধার করে!
পুনরুত্থানের দিন সন্ধ্যে বেলায় শিষ্যেরা যখন ইহুদী ধর্মনেতাদের ভয়ে খিল দিয়ে দরজা বন্ধ করে ছিল, যীশু তখন তাদের মাঝে এলেন। “তিনি তাদের বললেন, ‘তোমাদের শান্তি হোক!’” (যোহন ২০: ১৯) এই দর্শনে তিনি দু-দুবার শিষ্যদের শান্তি কামনা করেছেন। তিনি তাদেরকে ফু দিয়ে বললেন, “এবার তোমরা পবিত্র আত্মাকে গ্রহণ কর।” (যোহন ২০: ২২) তিনি দায়িত্ব দিলেন, “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও; বিশ্ব সৃষ্টির কাছে তোমরা ঘোষণা কর মঙ্গলসমাচার!” (মার্ক ১৬: ১৫)
আজকের পৃথিবীতে ভক্তজনগণ প্রেরিতদূতদের প্রতিনিধিত্ব করে প্রাবক্তিক ভূমিকায়। কিন্তু পারিবার্শ্বিক অবস্থায় মঙ্গলবার্তাকে প্রচার না করে আমরা লোকভয়ে নিজেদের খিল দিয়ে রাখি। আমাদের অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার জন্য পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট আমাদের মাঝে আসেন, তাঁর শান্তি আমাদের দান করেন, পবিত্রাত্মার শক্তিতে আমাদের পরিচালনা করেন, মঙ্গলবার্তাকে প্রচার করতে আমাদের নির্দেশ দেন।
শিষ্যদের সাথে তখন টমাস ছিলনা বলে সে খ্রীষ্টের উপস্থিতি স্বীকার করতে চাইলো না। সে বললো, “তাঁর দুটি হাতে যদি পেরেকের দাগ না দেখি, আর পেরেকের জায়গায় যদি আঙ্গুল না ছোঁয়াই, এবং তাঁর বুকের পাশটিতে যদি হাত দিতে না পারি, তবে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না!” (যোহন ২০: ২৫) তাই আরেকদিন যখন টমাস তাদের সাথে আছে, যীশু আবার এলেন। যীশু টমাসকে তাঁর ক্ষত স্পর্শ করার আমন্ত্রণ জানান ও বিশ্বাসী না হওয়ায় তিরস্কার করেন। তিনি বললেন, “আমাকে তুমি দেখেছ বলেই বিশ্বাস করেছ। যারা না দেখেও বিশ্বাস করে, ধন্য তারা!” (যোহন ২১: ২৯)
যখন আমরা বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ি, তখন প্রায়শঃ তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস হারাই, জাগতিক প্রমাণ দাবি করি। কিন্তু খ্রীষ্ট চাননা আমরা অবিশ্বাসী থাকি। পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট প্রমাণ ছাড়াই না দেখে বিশ্বাসের জীবনে আমাদের আরো শক্তিমান হওয়ার আহ্বান জানান।
দু-দুবার শিষ্যদের দেখা দেওয়ার পরেও তারা আবার তাদের পুরাতন পেশায় ফিরে গেল শিমন পিতরের নেতৃত্বে। তারা যখন মাছ পাচ্ছিল না, তখন তৃতীয়বারের মত খ্রীষ্টের উপস্থিতি ও নির্দেশে আবার জাল ফেলে প্রচুর পরিমাণে মাছ পেল। এ যেন শিষ্য বাছাইয়ের দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি! প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা ছিল সেই আহ্বানকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য, “এখন থেকে মানুষই ধরবে তুমি!” (লূক ৫: ১০) জাল, নৌকা সব ছেড়ে তারা সেদিন যীশুর পেছনে গিয়েছিল। তাই আবার জাল-নৌকায় ফিরে যাওয়া ছিল পরাজয়ের প্রকাশ! পিছিয়ে পড়ার চিহ্ন! তাঁর দেখিয়ে দেয়া পথে চলার জন্য তিনি গালীল সাগরের তীরে আবারো জীবনভোজে মিলিত হন।
আমরা যখন যীশুর সাথে সংযুক্ত না থাকি, জীবনের খেই তখন হারিয়ে ফেলি, ফিরে যেতে চাই পুরাতন অন্ধকারের পথে! আমরা যখন দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে পড়ি, পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট আমাদেরকে খ্রীষ্টযাগের মাধ্যমে পুরাতন আহ্বানকে স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রেরিত শিষ্য পিতরের উপরে যীশুর অনেক বিশ্বাস আর নির্ভরতা ছিল। কিন্তু মানবীয় দূর্বলতায় যীশুর সামনেই পিতর তাঁকে তিন-তিনবার অস্বীকার করেন; যদিও মুখে বলেছিল, কোন অবস্থাতেই সে যীশুকে ছেড়ে যাবেনা। পিতরের এই আচরণে যীশু হয়তো কষ্ট পেয়েছিলেন, আর পেয়েছিলেন বলেই তিন তিনবার তিনি জানতে চাইলেন, পিতর তাঁকে সত্যি ভালবাসে কিনা? আপাতঃ দৃষ্টিতে আমরা পিতরের এই অবস্থায় তাকে দূর্বল ভাবতেই ভালবাসি। কিন্তু কি আশ্চর্য, আর সবাইকে বাদ দিয়ে যীশু কিন্তু তাকেই বেছে নিলেন মণ্ডলীর দেখাশোনা করার জন্য, তার উপর মণ্ডলী প্রতিষ্ঠা করার জন্য! যীশু যখন পিতরকে প্রেরিত শিষ্য হিসেবে মনোনীত করেছিলেন, তখনই বলেছিলেন, “তুমি তো যোহনের ছেলে সিমন। শোন, তুমি কেফাস নামেই পরিচিত হবে। কেফাস কথাটির অর্থ পাথর।” (যোহন ১: ৪২) পাথরের উপরেই মণ্ডলীর ভিত্তি স্থাপন করে বললেন, “তাহলে তুমি আমার মেষদের দেখাশোনা কর!” (যোহন ২১:১৭)
খ্রীষ্টের পুনরুত্থানের আনন্দ পুনরুত্থান রবিবারের পর্বীয় অনুষ্ঠান পালনের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়ে যায়না, বরং পাস্কা রহস্যের নিগূড়তা ধ্যানের মধ্য দিয়েই শুরু হয় খ্রীষ্টিয় জীবনে আমাদের নবযাত্রা। পুনরুত্থিত খ্রীষ্টের অমূল্য সব উপহার খ্রীষ্টিয় জীবনের গভীরে প্রবেশে আমাদের উৎসাহিত করুক এই কামনা করি।