ঐতিহ্যগতভাবে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে বড়দিন উৎসব। বড়দিন অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বরকে যীশু খ্রীষ্টের জন্মোৎসব হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। খ্রীষ্ট বিশ্বাসীগণ বিশ্বাস করেন যে ঐ তারিখেই ২০১১ খ্রীষ্টাব্দ পূর্বে যীশু খ্রীষ্ট জন্মগ্রহণ করেছেন।
বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী খ্রীষ্টান হওয়ার সুবাদে বড়দিন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ধর্মীয় পর্বে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক পার্বনের রূপ লাভ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাই ডিসেম্বর মাসের আগমনেই শুরু হয়ে যায় সাজ-সাজ রব, প্রস্তুতির নানা আয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে এমনকি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আয়োজনের সমারোহ, রেডিও-টেলিভিশনে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের সম্প্রচার চোখে পড়ার মতই।
বাংলাদেশে খ্রীষ্টানদের সংখ্যা জাতীয় জনসংখ্যার তুলনায় নিতান্তই নগন্য। তথাপি খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা খ্রীষ্টের অনুসারী হিসেবে তাঁর জীবনের আলোকে সেবামুখী- বিশেষভাবে শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য দেখিয়ে চলেছে। তাই স্বল্প সংখ্যক খ্রীষ্টানগণও জগতের মাঝে লবণের ন্যায় সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে নিজেদের সেবামূলক উপস্থিতির। তাই সংখ্যার দিক থেকে ক্ষুদ্রতর এই সম্প্রদায়ের পরিচিতি দিন দিন ব্যাপৃত হচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বায়নের প্রভাবে বড়দিন এর আগমনী বার্তা সকল ধর্মাবলম্বীরাই ঘরে বসে টের পেয়ে যায়। বর্তমান সময়ে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বড়দিনকে ঘিরে নানা আয়োজনেই তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চট্টগ্রামে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিন পালনের ঐতিহ্য বহু পুরনো। কারণ চট্টগ্রামেই প্রথম ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে পর্তুগীজ বণিকদের আগমনের মাধ্যমে খ্রীষ্ট ধর্মের আগমন ও ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে তাদের বসতি স্থাপনের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে খ্রীষ্ট অনুসারীদের সংখ্যা। চট্টগ্রামের প্রধান কাথলিক চার্চ পবিত্র জপমালা রাণীর ক্যাথিড্রাল চার্চটি ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে পাথরঘাটায় গড়ে ওঠে অন্য নামে যা পরে ১৬০২ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান দস্যুদের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয় ও ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় বর্তমান নামে গঠিত হয়। একই সময়ে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে মরিয়ম আশ্রম দিয়াঙে একটি চার্চ ও জামালখানে আওয়ার লেডী অফ ইম্মাকুলেট কনসেপশন চার্চটি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে দিয়াং এর চার্চটি দুই বছর পরেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয় পাথরঘাটাস্থ চার্চটি ধ্বংসের সমসাময়িক সময়ে। কিন্তু জামালখানের চার্চটি বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৪ টি কাথলিক ধর্মপল্লী আছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শহরে তিনটি কাথলিক চার্চ খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক যত্ন নিচ্ছে। ইতোমধ্যে দুইটি চার্চের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- পাথরঘাটাস্থ পবিত্র জপমালা রাণীর ক্যাথিড্রাল চার্চ, জামালখানস্থ আওয়ার লেডী অফ ইম্মাকুলেট কনসেপশন চার্চ এবং পাহাড়তলীস্থ সেন্ট জন চার্চ। কাথলিক খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা এই তিনটি চার্চকে ঘিরে একত্রিত হয়েছে বড়দিনের বিশেষ উপাসনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। পাথরঘাটাস্থ ক্যাথিড্রাল চার্চে ২৪ ডিসেম্বর রাত ০৯.৩০টায় ইংরেজিতে, রাত ১২.০০টায় বাংলায় মধ্যরাতের মূল উপাসনা এবং ২৫ ডিসেম্বর সকাল ০৮.৩০টায় বাংলায় উপাসনা পরিচালিত হয়েছে। জামালখানস্থ চার্চে রাত ১১.৪৫ টায় ইংরেজিতে এবং সকাল ০৮.৩০ টায় বাংলায় উপাসনা পরিচালিত হয়েছে। পাহাড়তলীস্থ চার্চের উপাসনা বাংলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে সকাল ০৮.৩০টায়। সকল উপাসনা অনুষ্ঠানে খ্রীষ্টানগণ বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন সারা বিশ্বের সমস্ত খ্রীষ্টানদের সাথে একাত্ম হয়ে।
বড়দিন উপলক্ষে প্রতিটি চার্চ সেজে উঠেছে মোহনীয় সাজে। স্থাপনা ও দালানগুলো বিভিন্ন রঙ্গের বৈদ্যুতিক বাতিতে সকল মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে দর্শনযোগ্য। যীশু খ্রীষ্ট জন্ম নিয়েছেন বেথলেহেমের একটি গোয়াল ঘরে। সেই ঘটনা অনুকরণে প্রতিটি চার্চে সাজানো হয়েছে গোশালা ঘর। আকর্ষণীয় ক্রিসমাস ট্রি অবশ্যই জায়গা করে নিয়েছে প্রতিটি চার্চে। পাথরঘাটাস্থ ক্যাথিড্রাল চার্চের বেল টাওয়ারের চূড়াটির আলোক-সজ্জা বহুদূর থেকেই চোখে পড়ে মানুষের।
বড়দিনকে ঘিরে খ্রীষ্টানদের প্রস্তুতি অনেক দীর্ঘ। পাড়ায় পাড়ায় চার সপ্তাহ আগে থেকে চলে প্রার্থনা অনুষ্ঠান, মন পরিবর্তনের আহ্বান। চার্চে পর্যায়ক্রমে বড়দিনের আগের চার রবিবারে জ্বালানো হয় চারটি মোমবাতি। একে একে জ্বলে ওঠা চারটি মোমবাতি প্রকাশ করে খ্রীষ্টের আগমনে মানুষের মনের ও সমাজের সকল কালো দূরীভূত হওয়ার আহ্বানকে। এভাবেই হৃদয়কে সাজিয়ে নিয়ে, জাগতিকভাবেও নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে খ্রীষ্টানগণ। বিশেষভাবে প্রায় প্রতি ঘরেই সাজানো হয় ক্রিসমাস ট্রি। কিছু ঘরে গোশালা ঘরও সাজানো হয়। আর ক্রিসমাস এর বিশেষ তারার কথা তো বলাই বাহুল্য। রঙ্গিন কাগজে সাজানো তারার মধ্যে বৈদ্যুতিক বাতি থাকে আর বহুদূর থেকে জ্বলজ্বলে তারা দেখা যায় বিভিন্ন বাড়ীর ছাদে। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের পরে আকাশে বিশেষ একটি উজ্জ্বল তারা দেখেই প্রাচ্য দেশ থেকে বহু পথ পাড়ি দিয়ে তিনজন পণ্ডিত এসেছিলেন যীশু খ্রীষ্টকে দেখতে। তাই ক্রিসমাস ঐতিহ্যে এই তারার রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। সাজ-সজ্জার কাজে বাড়ীর শিশুদের কোলাহল, আনন্দ আর উৎসাহ থাকে চোখে পড়ার মত। আর্থিক সংগতি অনুযায়ী নতুন পোশাকে সাজিয়ে নিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলে।
বড়দিনের আগে বিভিন্ন শিশু ও যুব সংগঠন এমনকি বড়দের সংগঠনও দল বেধে বাড়ী থেকে বাড়ীতে যায় বড়দিনের গান গেয়ে শোনাতে। এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। বড়দিনের কীর্তন বলা হয় একে। এছাড়াও বড়দিনকে ঘিরে পাথরঘাটাস্থ কাথলিক ক্লাবে ২২ ডিসেম্বর রাতে অনুষ্ঠিত হলো শিশু সমাবেশ। এই সমাবেশে সান্তা ক্লজ উপস্থিত হয়ে শিশুদের উপহার দিয়ে আনন্দিত করেছে। কাথলিক ক্লাবে ১ জানুয়ারী পর্যন্ত বড়দিন উপলক্ষে চলতেই থাকে একের পর এক আনন্দোৎসবের আয়োজন। জামালখানে বসবাসরত শ্রীলঙ্কান ছাত্র-ছাত্রীরা ২০ ডিসেম্বর রাতে এক বিশেষ বড়দিন কীর্তন আয়োজন করেছে। এই কীর্তনের খ্যাতি চট্টগ্রামের সমস্ত খ্রীষ্টানদের মাঝেই। বিদেশের মাটিতে এই একটি দিন শ্রীলঙ্কানরা যেন মেতে ওঠে বড়দিনের আনন্দে বাঙ্গালী খ্রীষ্টানদের সাথে একাত্ম হয়ে।
চট্টগ্রামে কিছু সংখ্যক স্থানীয় খ্রীষ্টানদের পাশাপাশি বেশীরভাগ খ্রীষ্টানই মূলত বরিশাল বিশেষভাবে পাদ্রীশিবপুর এবং নোয়াখালী থেকে আসা স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাসরত অভিবাসী। পিঠা-পুলিতে তাই বাড়ী থেকে বাড়ীতে বৈচিত্র্য দেখা যায়। তথাপি বড়দিনের জন্য অর্ডার দিয়ে কেক বানানো চট্টগ্রামের এক বিশেষ ঐতিহ্য। বড়দিনের বহু আগে থেকেই বিভিন্ন বেকারীতে কেক বানানোর জন্য সিডিউল নিতে হয়, নতুবা শেষকালে কেক বানানো সম্ভব হয়না। যারা অর্ডার দিয়ে বানাতে পারেন না, তারাও রেডিমেড কেক কিনে আনতে ভুল করেন না। চট্টগ্রামে কেক নিয়ে এই প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার খ্রীষ্টানদের চাইতে একটু আলাদা। এছাড়াও বাড়ীতে তৈরী পিঠার মধ্যে দোদল (পর্তুগীজ পিঠা), বিরিঙ্কা (পর্তুগীজ পিঠা), ডো-নাট, পুলি পিঠা, পাঠিসাপ্তা পিঠা, নোন্তা পিঠা, খেজুড় পিঠা, পাপড়ি, ইত্যাদি হরেক রকম পিঠার গন্ধে মঁ মঁ করতে থাকে খ্রীষ্টান বাড়ীগুলো। ২৫ ডিসেম্বর তারিখ বেশীরভাগ খ্রীষ্টানগণই ব্যস্ত থাকে অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়নে। ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় মূলত খ্রীষ্টানদের এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় বড়দিন উপলক্ষে ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় এক বিশেষ অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স¤প্রদায়ের ও বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ চট্টগ্রামের বিশপ ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে আসেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র মনজুরুল আলম বিশপ মজেস এম. কস্তা, সিএসসির সাথে কেক কাটবেন। এছাড়াও স্থানীয় সাংসদ নূরূল ইসলাম, বিএসসি, বিভিন্ন দূতাবাস, সরকারী ও বেসরকারী দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন ধর্মীয় নের্তৃবৃন্দ, ব্যবসায়ীবৃন্দ খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের বন্ধুদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে ছুটে আসেন। চার্চ পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, চার্চের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সহকর্মীবৃন্দও এই দিনটিতে বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতা করতে অপেক্ষা করে থাকে।
চট্টগ্রামের কাথলিক চার্চের ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও বাংলাদেশ টেলিভিন চট্টগ্রাম কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ বেতার, চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠান। এছাড়া বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বড়দিনকে নানামুখী আয়োজন তো থাকছেই।
বড়দিনে খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা হৃদয়কে নতুন করে সাজানোর সঙ্কল্প নেয়। যীশু খ্রীষ্ট মানবতাবাদী সংস্কারক। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাই খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা শপথ নেয় যেন বড়দিনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সাথে অধিকতর উত্তম এক সমাজ গড়ে তুলতে পারে।