ঐশরাজ্যের সূচনা
পুণ্য মণ্ডলীর রহস্য তার গোড়াপত্তনের মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কারণ বহুকাল ধরে প্রতিশ্রুত ঐশরাজ্যের আগমনের শুভবার্তা ঘোষণা ক’রে প্রভু যীশু মণ্ডলী সূচনা করেছেন। তখন তিনি বলেছেন, “সময় হয়ে এসেছে: ঐশরাজ্য এখন খুব কাছেই” (মার্ক ১:১৫, মথি ৪:১৭)।
মানুষের জন্যে ক্রুশে মৃত্যুবরণ করার পর যীশু যখন মৃত্যুলোক থেকে পুনরুত্থান করলেন তখন তাঁকে “প্রভু”, “খ্রীষ্ট” ও “চিরকালীন যাজক” রূপে নিযুক্ত করা হল (দ্র: শিষ্য ২:৩৬; হিব্রু ৫:৬; ৭:১৭-২১) এবং তিনি প্রতিশ্রুত আত্মাকে তাঁর শিষ্যদের নিকট প্রেরণ করলেন (দ্র: শিষ্য ২: ২৩)। তখন থেকেই মণ্ডলীর প্রতিষ্ঠাতা সেই খ্রীষ্টের অনুগ্রহদান দ্বারা ভূষিত হয়ে এবং তাঁর প্রেম, নম্রতা ও আত্মত্যাগের নির্দেশ বিশ্বস্তভাবে পালন ক’রে, মণ্ডলী সমগ্র জাতির কাছে খ্রীষ্টের এবং ঈশ্বরের রাজ্য ঘোষণা এবং প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব লাভ করেছে। এই জগতে মণ্ডলী হল সেই ঐশরাজ্যেরই বীজ ও সূচনা।
মণ্ডলী সম্পর্কে উপমা
মণ্ডলী হচ্ছে চাষের জমি, ঈশ্বরের কর্ষিত ভূমি (১ করি ৩:৯)। উক্ত জমিতে প্রাচীন জলপাই বৃক্ষটি বেড়ে উঠেছে; সেই বৃক্ষের শেকড় হচ্ছেন প্রবক্তাগণ; সেই বৃক্ষের শাখা প্রশাখায় ইহুদী-অনিহুদীর মিলন সাধিত হয়েছে এবং পুনর্বার সাধিত হবে (রোমীয় ১১:১৩-২৬)। সেই ক্ষেত্রটি উৎকৃষ্ট আঙ্গুরক্ষেত রূপেই স্বর্গীয় মালিকদের দ্বারা রোপন করা হয়েছে (মথি ২১: ৩৩-৪৩; দ্র: ইসা ৫: ১ এবং তৎপরবর্তী)। অবশ্য দ্রাক্ষালতা হচ্ছেন খ্রীষ্ট নিজে, যিনি শাখা-প্রশাখা অর্থাৎ আমাদের মধ্যে জীবনরস সঞ্চার করেন, আমাদেরকে ক’রে তোলেন ফলশালী। মণ্ডলীর মাধ্যমে আমরা খ্রীষ্টের সাথে সংযুক্ত থাকি, কেননা তাঁকে ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না (যোহন ১৫:১৫)।
মণ্ডলীকে অনেক সময় ঈশ্বরের গৃহ বলেও অভিহিত করা হয় (১ করি ৩:৯)। এমনকি প্রভু নিজেকে তুলনা করেছেন সেই প্রস্তরের সাথে যা গৃহনির্মাতারা উপেক্ষা করেছিল, কিন্তু তা হয়ে উঠেছে ভিত্তি-প্রস্তর (মথি ২১:৪২; দ্র: শিষ্য ৪:১১;১ পিতর ২:৭: সাম ১১৭:২২)। সেই ভিত্তি-প্রস্তরের উপরই মণ্ডলী প্রেরিতদূতদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে (১ করি ৩:১১) এবং সেখান থেকেই মণ্ডলী লাভ করেছে দৃঢ়তা ও সংহতি। বিভিন্ন নামে এই গৃহের বর্ণনা দেয়া হয়ঃ একে বলা হয় ঈশ্বরের গৃহ যেখানে তাঁর পরিবারের সকলে বাস করে; পবিত্র আত্মার অনুপ্রাণনে পরমেশ্বরের আবাসগৃহ (এফে ২:১৩,২২); মানুষের মাঝে পরমেশ্বরের আবাস (প্রত্যা ২১:৩); এবং বিশেষভাবে বলা হয়েছে পবিত্র মন্দির।
তাছাড়া মণ্ডলীকে “উর্ধ্বলোকের জেরুশালেম” এবং “আমাদের জননী” বলে আখ্যায়িত ক’রে (গালা ৪:২৬ এবং তৎপরবর্তী; দ্র: প্রত্যা ১২:১৭) নিষ্কলঙ্ক মেষশাবকের নিষ্কলঙ্কা বধূ বলে বর্ণনা করা হয়েছে (প্রত্যা ১৯:৭, ২১:২, ৯; ২২:১৭)। তাকেই “খ্রীষ্ট ভালবেসেছেন, তার জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন যে তিনি তাকে পবিত্র ক’রে তুলতে পারেন” (এফে ৫:২৬)
খ্রীষ্টদেহরূপ মণ্ডলী
খ্রীষ্টপ্রসাদীয় রুটিভাঙ্গা অনুষ্ঠানে প্রভুর দেহ গ্রহণের মাধ্যমে খ্রীষ্টের সাথে এবং পরস্পরের সাথে আমাদের মিলন ঘটে। যেহেতু সেই রুটি এক, তাই অনেক হয়েও আমরা এক দেহ, কারণ আমরা সকলেই সেই একই রুটির অংশভাগী” (১ করি ১০:১৭)। এভাবে আমরা সবাই তাঁর দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (দ্র: ১ করি ১২:১৭), “অনেক হয়েও পরস্পরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ” (রোমীয় ১২:৫) ।
মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বহু হয়েও সকলে মিলে যেমন একটি দেহ গঠিত হয় ঠিক তেমনি খ্রীষ্টেতে সকল বিশ্বাসীরা একদেহ হয়ে উঠে (১ করি ১২:১২)। খ্রীষ্টদেহ গঠনেও বিভিন্ন ভক্তজন ও তাদের বিভিন্ন কর্তব্য রয়েছে।
খ্রীষ্ট হলেন এই দেহের মস্তক। তিনিই অদৃশ্য পরমেশ্বরের প্রতিমূর্তি এবং তাঁতেই সমস্ত কিছু অস্তিত্ব পেয়েছে। তিনিই সেই দেহের অর্থাৎ খ্রীষ্টমণ্ডলীর মস্তকস্বরূপ।
কাথলিক বিশ্বাসীবর্গ
পৃথিবীতে অবস্থানরত তীর্থযাত্রী মণ্ডলী পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন, কেননা খ্রীষ্ট হচ্ছেন পরিত্রাণের একমাত্র মাধ্যম ও পথ এবং সেই খ্রীষ্ট তাঁর দেহ অর্থাৎ মণ্ডলীতে উপস্থিত আছেন। তিনি নিজেই বিশ্বাস ও দীক্ষাস্নােনের প্রয়োজনের কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন (দ্র: মার্ক ১৬:১৬; যোহন ৩:৫) এবং তৎসঙ্গে, একই সময়ে জোর দিয়ে মণ্ডলীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন যার ভেতরে মানুষ প্রবেশ করে দ্বারস্বরূপ দীক্ষাস্নানের মধ্য দিয়ে। অতএব যারা জানে যে, খ্রীষ্টের মাধ্যমে ঈশ্বর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কাথলিক মণ্ডলী একান্ত আবশ্যক অথচ তারা সেই মণ্ডলীতে প্রবেশ করতে বা তাতে অবস্থান করতে অস্বীকার করে, তারা পরিত্রাণ লাভ করতে পারে না। মণ্ডলীতে তারাই পূর্ণ সভ্য, যারা খ্রীষ্টের আত্মা লাভ ক’রে সমস্ত সংগঠনসহ মণ্ডলীতে প্রদত্ত পরিত্রাণের সকল উপায় গ্রহণ করে এবং যারা ধর্মবিশ্বাস, সংষ্কারসমূহ, মাণ্ডলিক প্রশাসন ও মিলনবন্ধনে আবদ্ধ থেকে পোপ মহোদয় ও বিশপগণের মাধ্যমে খ্রীষ্ট-পরিচালিত মণ্ডলীর দৃশ্য কাঠামোর সাথে সংযুক্ত থাকে। মণ্ডলীভুক্ত হয়েও কেউ যদি প্রেমের বন্ধনে বিশ্বস্ত না থাকে, তাহলে সে পরিত্রাণ লাভ করতে অক্ষম। তবে মণ্ডলীর সকল সন্তানকে স্মরণ রাখতে হবে যে, খ্রীষ্টের অনুগ্রহেরই ফলে তারা এই মহান মর্যাদা পেয়েছেন, নিজস্ব কোন যোগ্যতা বলে নয়।
মণ্ডলীর প্রেরণকার্য
পিতা যেমন পুত্রকে প্রেরণ করেছিলেন, পুত্রও তেমনি প্রেরিতদূতদের প্রেরণ ক’রে বলেছিলেনঃ “সুতরাং যাও, তোমরা গিয়ে সকল জাতির মানুষকে আমার শিষ্য কর; পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে তাদের দীক্ষাস্নাত কর; তোমাদের যা কিছু আদেশ দিয়েছি, তাদের তা পালন করতে শেখাও। আর জেনে রাখ, জগতের সেই অন্তিমকাল পর্যন্ত আমি সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে আছি” (মথি ২৮: ১৮-২০)। প্রেরিতদূতদের কাছ থেকে মণ্ডলী খ্রীষ্টের এই মহা নির্দেশ পেয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত এই নির্দেশ পূর্ণ করতে মণ্ডলী বাধ্য (দ্র: শিষ্য ১:৮)। তাই মণ্ডলী প্রেরিতদূতদের এই কথা নিজের ক’রে বলেঃ “ধিক আমাকে, যদি আমি মঙ্গলসমাচার প্রচার না করি” ( ১ করি ৯:১৬); আর সেই কারণে মণ্ডলী অনবরত মঙ্গলসমাচার প্রচারকদের প্রেরণ ক’রে থাকে যে পর্যন্ত-না শিশুমণ্ডলীগুলো সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মঙ্গলবাণী প্রচারের কাজ নিজেরাই চালিয়ে যেতে পারে।
মঙ্গলসমাচার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করতে ও তা স্বীকার করতে মণ্ডলী লোকদের অনুপ্রেরণা দেয়, তাদেরকে দীক্ষাস্নানের জন্যে প্রস্তুত করে, মিথ্যার দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত করে এবং খ্রীষ্টের সঙ্গে তাদেরকে সংযুক্ত করে যেন খ্রীষ্টপ্রেমে তারা পূর্ণ পরিপক্কতা লাভ করে।
তাই মণ্ডলী সর্বদা প্রার্থনা করে এবং পরিশ্রম করে যেন সমগ্র জগৎ পবিত্র আত্মার মন্দির এবং খ্রীষ্টের দেহ সেই ঐশ জনগণের মধ্যে পূর্ণতা লাভ করতে পারে এবং সমস্ত সৃষ্টির প্রধান সেই খ্রীষ্টের মাধ্যমে বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্বপিতা পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে যেন সকল গৌরব ও মহিমা কীর্তিত হয়।
প্রশাসনের ভিত্তিমূল
ঐশ জনগণের মধ্যে পালকীয় কর্তব্য পালনের জন্যে এবং অবিরত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে মণ্ডলীতে খ্রীষ্ট বিভিন্ন দায়িত্ব স্থাপন করেছেন। সেই দায়িত্বসমূহের লক্ষ্য হচ্ছে গোটা দেহের মঙ্গলসাধন। প্রথম ভাটিকান মহাসভার পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে এই মহাসভা শিক্ষা দিচ্ছে এবং ঘোষণা করছে যে, অনন্তকালীন পালক স্বয়ং খ্রীষ্ট-যীশু যেমন পিতার দ্বারা প্রেরিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি তিনিও প্রেরিতদূতদের উপর প্রেরণকর্মের দায়িত্ব ন্যস্ত ক’রে পবিত্র মণ্ডলী স্থাপন করেছেন (দ্র: যোহন ২০:২১)। তিনি চেয়েছিলেন যেন প্রেরিতদূতগণের উত্তরাধিকারী অর্থাৎ বিশপ বা ধর্মপালগণ জগতের শেষ দিন পর্যন্ত মণ্ডলীর পালক হয়ে থাকেন। প্রেরিতদূতদের উত্তরাধিকারী ধর্মপালগণ খ্রীষ্টের প্রতিনিধি এবং সমগ্র মণ্ডলীর দৃশ্য মস্তক সেই পিতরের উত্তরাধিকারীর একাত্মতায় জীবন্ত ঈশ্বরের গৃহকে পরিচালনা দিয়ে থাকেন।
ধর্মপালগণ খ্রীষ্টসমাজের দায়িত্বভার হাতে পেয়েছেন। ধর্মপালদের সহকারীরূপে আছেন যাজক ও পরিসেবকগণ। ধর্মপালগণ ঈশ্বরের স্থলে মেষপালের উপর সভাপতিত্ব করেন; এই মেষপালেরই পালক তাঁরা। পালক হিসাবে তাঁরা ধর্মবিশ্বাসের শিক্ষাদাতা, পুণ্য উপাসনার সেবাকর্মী এবং মণ্ডলীর প্রশাসনিক দায়িত্বভারপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ।
ঈশ্বর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গুণে মণ্ডলীর পালক হিসাবে ধর্মপালগণ প্রেরিতশিষ্যদের উত্তরাধিকারী। অতএব যারা তাঁদের কথা শোনে, তারা খ্রীষ্টেরই কথা শোনে এবং যারা তাঁদেরকে অগ্রাহ্য করে, তারা খ্রীষ্টকে এবং যিনি খ্রীষ্টকে পাঠিয়েছেন তাঁকেও অগ্রাহ্য করে (দ্র: লুক ১০:১৬)।
যাজকবৃন্দ
পিতা পরমেশ্বর খ্রীষ্টকে অভিষিক্ত ক’রে এই জগতে প্রেরণ করেছেন (যোহন ১০:৩৬)। খ্রীষ্ট তাঁর প্রেরিতদূতদের উত্তরাধিকারী ধর্মপালদেরকে একই অভিষেক ও প্রেরণকর্মের অংশীদার করেছেন। আর ধর্মপালগণ নিজ দায়িত্ব বলে মণ্ডলীর বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন পর্যায়ে সেবাকর্মের দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন। এভাবে মণ্ডলীর প্রথম যুগ থেকে খ্রীষ্ট প্রতিষ্ঠিত মাণ্ডলিক সেবাকর্ম বিভিন্ন পর্যায় অনুসারে ধর্মপাল, পুরোহিত ও পরিসেবকদের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে আসছে। যাজকীয় ক্ষমতার পূর্ণ অধিকার পুরোহিতদের যদিও নেই, যদিও তারা সেই ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য ধর্মপালদের উপর নির্ভরশীল, তথাপি সর্বশ্রেষ্ঠ ও শাশ্বত যাজক খ্রীষ্টের আদর্শ অনুকরণে ( হিব্রু ৫:১-১০; ৭:২৪; ৯:১১-২৮), ধর্মপালদের সাথে তারাও যাজকীয় মর্যাদায় ভূষিত। তারা সকলের কাছে ঐশবাণী ঘোষণা করেন। তবে খ্রীষ্টযাগে অনুষ্ঠানে বা খ্রীষ্টযাগে সম্মিলিত ভক্তসমাজে তারা তাদের পবিত্র দায়িত্ব সর্বোত্তমভাবে পালন ক’রে থাকেন। পুরোহিতগণ হলেন ঐশ জনগনের সেবার্থে আহূত ধর্মপাল-ভ্রাতৃসংঘের বিচক্ষণ সহকর্মী, তাদের সমর্থক ও মুখপাত্র। সকল পুরোহিত – ধর্মপ্রদেশীয় হোক বা সন্ন্যসব্রতীই হোক – যাজকবরণ সংষ্কার ও সেবাকর্মের কারণে ধর্মপালদের ন্যায় ও তাঁদের সহযোগী হয়ে এবং তাঁদের আহ্বান ও প্রাপ্ত অনুগ্রহ অনুসারে সমগ্র মণ্ডলীর কল্যাণার্থে নিয়োজিত।
ভক্তজনসাধারণের স্বরূপ ও কর্তব্যসমূহ
ধর্মপাল, যাজক ও পরিসেবক পদে অভিষিক্ত ব্যক্তিদের এবং মণ্ডলী কর্তৃক অনুমোদিত সন্ন্যাসব্রতীদের ব্যতীত সকল খ্রীষ্টবিশ্বাসীদেরকে ভক্তজনসাধারণ বলে এখানে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অর্থাৎ ভক্তজনসাধারণ হলেন সেই সকল বিশ্বাসী যারা দীক্ষাস্নানে মাধ্যমে খ্রীষ্টের সাথে সংযুক্ত, ঐশ জনগণের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের আপন আপন অবস্থা অনুসারে খ্রীষ্টের রাজকীয়, যাজকীয় ও প্রাবক্তিক দায়িত্বে অংশীদার হয়ে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী জগতে ও মণ্ডলীতে গোটা খ্রীষ্টিয় জনগণের প্রেরণকর্মে নিয়োজিত। ভক্তজনসাধারণের একক বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তারা জগৎ-সংসারে বাস করেন।
ভক্তজনসাধারণের মর্যাদা
পুণ্য মণ্ডলী, ঈশ্বরের ব্যবস্থা অনুসারে অপূর্ব বৈচিত্র্যের সাথে সংগঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। “কারণ আমাদের এই এক দেহে যেমন অনেকগুলি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে এবং সকল অঙ্গের কাজ যেমন এক নয়, আমরাও তেমনি অনেক হয়েও খ্রীষ্টের সঙ্গে মিলনাবদ্ধ বলেই এক দেহ এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমরা পরস্পরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ” (রোমীয় ১২: ৪-৫)।
ঈশ্বরের মনোনীত জাতি একটিই: “প্রভু এক, বিশ্বাস এক, দীক্ষাস্নান এক” (এফে ৪:৫); খ্রীষ্টে নতুন জন্মগ্রহণ ক’রে সকলে একই মর্যাদার অধিকারী, সকলেই সন্তান হওয়ার অনুগ্রহ পেয়েছে, পবিত্র হতে সকলেই আহূত; সকলের জন্য একই পরিত্রাণ, একই আশা, অভিন্ন প্রেম। খ্রীষ্টেতে সবাই এক; মণ্ডলীর মধ্যে বংশ বা জাতি, সামাজিক অবস্থা বা নারী- পুরুষে কোন বৈষম্য নেই কেননা “তোমাদের মধ্য এখন ইহুদীও নেই; অনিহুদীও নেই; ক্রীতদাসও নেই, স্বাধীন মানুষও নেই, পুরুষও নেই, নারীও নেই; কারণ খ্রীষ্ট-যীশুর সঙ্গে মিলিত হয়ে এখন তোমরা সকলেই এক হয়ে আছ” (গালা ৩:২৮; কল ৩:১১)। মণ্ডলীতে সকলেই একই পথ ধরে চলে না; তথাপি সবাই পবিত্র হতে আহূত এবং ঈশ্বরের বিচারে প্রত্যেকেই বিশ্বাসের সমান অধিকার পেয়েছে (দ্র: ২ পিতর ১:১১)।
ভক্তজনসাধারণের প্রৈরিতিক সেবাকাজ
ঐশ জনগণরূপে এবং একই মস্তকের অধীনে খ্রীষ্টের দেহরূপে ভক্তজনসাধারণের একটি বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছেঃ মণ্ডলীকে গড়ে তোলা এবং অবিরাম তা পবিত্র করার জন্যে সর্বক্ষমতা ব্যবহার করা। মণ্ডলীর মুক্তিদায়ী প্রেরণকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাই হচ্ছে ভক্তজনসাধারণের প্রৈরিতিক কাজ। দীক্ষাস্নান ও হস্তাপর্ণের দ্বারা প্রভু নিজেই তাদেরকে এই কাজে নিয়োগ করেছেন।
পালকগণ ও ভক্তজনসাধারণ
সকল খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের মত ভক্তজনসাধারণেরও অধিকার রয়েছে মণ্ডলীর আধ্যাত্মিক সম্পদ থেকে প্রচুর পরিমাণে সাহায্য পাওয়ার। বিশেষ ক’রে পালকদের কাছ থেকে ঐশবাণী শোনা এবং সংষ্কারসমূহ গ্রহণ করার অধিকার তাদের আছে। মণ্ডলী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা তাদের অভিমত তুলে ধরবেন। সততা, সৎ-সাহস ও বিবেচনার সাথে এবং খ্রীষ্টের প্রতিনিধি হয়ে যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের প্রতি সহৃদয় ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে তারা তাদের মতামত জানাবেন। সকল খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের মত ভক্তজনসাধারণেরাও খ্রীষ্টের প্রতিনিধি এবং মণ্ডলীর শিক্ষক ও পরিচালক সেই পালকদের সিদ্ধান্ত খ্রীষ্টিয় বাধ্যতার সহিত গ্রহণ করবেন। যাদের দায়িত্বাধীনে তারা ন্যস্ত, তাদের উপরে যারা সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখছেন কেননা তাদেরকে তো একদিন জবাবদিহি করতে হবে, সেই পালকদের জন্যে ভক্তজনসাধারণেরা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করবেন যেন তারা দুঃখ নয় বরং আনন্দমনে তাদের কাজ করতে পারেন (দ্র: হিব্রু ১৩:১৭)। মণ্ডলীতে ভক্তজনসাধারণের মর্যাদা ও দায়িত্বের স্বীকৃতি দেয়া এবং তারা বৃদ্ধি সাধন করা পালকদের কর্তব্য। তাদের বিবেচনাপূর্ণ পরামর্শ গ্রহণ করতে পালকগণ ইচ্ছুক হবেন এবং আস্থার সঙ্গে মণ্ডলীর সেবাকর্মে তাদেরকে নিযুক্ত করবেন, আর কাজ করার জন্য তাদেরকে দেবেন যথেষ্ট স্বাধীনতা। তাদেরকে সাহস দেবেন যেন তারা নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন কাজ হাতে নিতে পারেন।