অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। অশেষ প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ কখনো পরিচিত হয়েছে উপজাতি, কখনো আদিবাসী আবার কখনো পাহাড়ী হিসেবে, যেভাবে আমরা চেয়েছি। এই অঞ্চলে ১৩টি জনগোষ্ঠীর বসবাস, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারেই জীবন নির্বাহ করেছে, থেকেছে তুষ্ট। এখন পর্যন্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহের প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষিকাজ: জুম চাষই যার একমাত্র অবলম্বন। অতীতে জুমের ফসল দিয়েই তাদের সংসার চলে যেত। বাজারে আসতে হতো তাদের মাত্র লবন আর কেরোসিন এর জন্য। নিজেদের মধ্যে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে জীবন কাটানোই ছিল তাদের জীবন যাপনের ধারা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হতে থাকে, মানুষের স্বার্থান্বেষী চিন্তা আগ্রাসী হয়ে উঠতে থাকে। ব্যাপকভাবে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী দেশের সবচাইতে কম ঘনবসতিপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসী হতে শুরু করে। শুরু হয় পাহাড়ে অস্থিরতা। বাঙ্গালী সেটলারদের হাতে দখলীয় জমি হারিয়ে কমে যেতে থাকে জুম চাষ। সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ওঠে পাহাড়ীদের জীবন। হারিয়ে যায় শান্তি ও সমৃদ্ধি। ফলশ্রুতিতে যে অবস্থা বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে:
জানমালের নিরাপত্তার অভাব: পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বাড়ী-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাদেরকে নিজ দখলীয় ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যেন নিয়মিত ব্যাপার। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ’যাবত কমপক্ষে ১৩টি এই ধরণের ব্যাপক ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনাগুলোতে পাহাড়ীরা নির্বিচারে প্রাণ হারিয়েছে, বিকলাঙ্গ হয়েছে, নারীরা ধর্ষিতা হয়েছে, তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে, বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়: এইসব বেশীরভাগ ঘটনার সাথেই স্থানীয় প্রশাসন হয় সরাসরি জড়িত ছিল নয়তো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়ে পাহাড়ীরা হয় ভারত বা মায়ানমারে পালিয়ে যায় অথবা পাহাড়েই অন্যত্র সরে পড়ে। চাকমা ও মার্মা জনগোষ্ঠী হতে সার্কেল চীফ বা রাজা থাকায় তারা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও অপর ১১টি জনগোষ্ঠীর অবস্থা একেবারেই শোচনীয়।
সেটলারদের প্রবেশ: ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কমপক্ষে ৫০০,০০০ বাঙ্গালী পাহাড়ে প্রবেশ করেছে। এই সেটলাররা হয় পাহাড়ীদের জায়গা জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে অথবা ইতোপূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে বিতাড়িত হওয়া পাহাড়ীদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শান্তি চুক্তি হওয়ার পরে পূর্বে বিতারিত হওয়া প্রায় ৪৩,০০০ পাহাড়ী শরনার্থী ফিরে এসেছে কিন্তু তাদের অর্ধেকেরও বেশী জনগোষ্ঠী পূর্বের জায়গা জমি ফিরে পায়নি। এখন পর্যন্ত তারা বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। ৬৫,০০০ পাহাড়ী দেশ ত্যাগ না করেও নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা: পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত সহিংসতায় পাহাড়ী নারীরা সবচাইতে বেশী অসহায়। বাঙ্গালী সেটলাররা বিভিন্ন সুযোগে পাহাড়ী নারীদের ধর্ষণে জড়িত হচ্ছে। নারীরা দুইভাবে আক্রমনের শিকার: প্রথমতঃ তারা নারী এবং দ্বিতীয়তঃ তারা শত্রুপক্ষের নারী। Hill Women’s Federation এর হিসাবমতে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী থেকে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের জুন পর্যন্ত মাত্র ১৫ মাসে ধর্ষিতা হয়েছে ১৬৭ পাহাড়ী নারী। এ’তো মাত্র যে ঘটনাগুলো প্রকাশিত হয়েছে তা। এর বাইরেও আরো ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, সামাজিক কারণে ও লজ্জায় যা পাহাড়ীরা প্রকাশ করতে চায়না বলে হিসাবে আসেনি।
ভিন্নধর্মী প্রশাসন: ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে যখন শান্তি চুক্তি করা হয় তখন জাতি সংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং পৃথিবীর বহু দেশ তাকে স্বাগত জানিয়ে প্রশংসা করেছিল। কিন্তু আজ ২০ বছর পরে দেখা যায় শান্তি চুক্তির খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরকার কর্তৃক সকল সেনা ক্যাম্প তুলে নেয়ার কথা। মাত্র সীমান্তরক্ষী এবং পুলিশ সে এলাকায় থাকার কথা। কিন্তু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৫০০ সেনা ক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ২৯টি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনভাগের একভাগকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন করা হয়েছে অথচ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের আয়তনের দশভাগের একভাগ মাত্র এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর একভাগেরও কম। সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এতটাই দৃশ্যমান যে, এখানে সেখানে চোখে পড়ে সেনা ক্যাম্প, গ্যারিসন, চেক পোস্ট ইত্যাদি। হঠাৎ আসা কোন আগন্তুক পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি যুদ্ধ এলাকা হিসেবে ভুল করে ফেলতে পারে খুব সহজেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনে সেনাবাহিনীর ব্যাপক প্রভাব আছে। পাহাড়ীরা সেনাবাহিনীকে ভয় পায়।
খাদ্যাভাব: বর্তমানে জুম চাষে সম্ভাব্যতা ক্রমে হ্রাস পাওয়ায় ও ফলন কম হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বছরে ৫ থেকে ৬ মাস ব্যাপি খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তবে দুঃখের বিষয় এসময় প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রদানে সরকারী বেসরকারী সহায়তা নেই বললেই চলে। আবার সরকারি বরাদ্দ পেলেও খাদ্য সহায়তা যথা সময়ে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি সমাধানের কোন স্থায়ী ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত তৈরী হয়নি। ফলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে দুর্গম এলাকার জনগণ বিশেষভাবে মা ও শিশুরা।
চিকিৎসা: প্রত্যন্ত এলাকায় কিছু সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার ও অন্যান্য কর্মীগণ বেশীরভাগ সময়ই এলাকায় থাকেননা। যদিও তারা নিয়মিতভাবে বেতন ভাতা উত্তোলন করেন। ফলে চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিবাসিরা বিশেষভাবে পাহাড়ী জনগণ। ফলে মা, শিশু ও বিভিন্ন রোগে বিশেষ ভাবে ম্যালেরিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েড ও ডায়রিয়ায় মত সাধারণ রোগে অনেক মানুষের মুত্যু ঘটে।
শিক্ষা: পাহাড়ীরা দূর্গম এলাকায় পাড়া ভিত্তিক বসবাস করে। বেশীরভাগ পাড়াই বর্ষা মৌমুমে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রতিটি পাড়ায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। দূরের পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও শিশুরা অনেক দূরের পথ হেঁটে যেতে পারেনা বিশেষভাবে বর্ষাকালেতো একেবারেই না। ফলে শিশুরা ঝরে পড়ে প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই। উচ্চ বিদ্যালয়তো আরো অপ্রতুল। দূর দূরান্তের প্রত্যন্ত পাড়া থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, নিজেদের আবাসনের ব্যবস্থা নিজেরা করে লেখাপড়া চালানো দরিদ্র পাহাড়ীদের পক্ষে একপ্রকার অসম্ভবই বলতে হয়। তদুপরি প্রত্যন্ত এলাকায় সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীগণ এলাকায় না থেকেই বেতন ভাতা গ্রহণ করেন। ফলে বিদ্যালয়ের দালান থাকলেও বেশীরভাব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষা কার্যক্রম চলেনা। বিভিন্ন এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীগণ পাড়াভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা এ’যাবতকাল পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সরকার শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করায় এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের পক্ষে এই বিষয়ে কাজ করা রীতিমত দুরুহ হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার ক্ষেত্রে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী আরো পিছিয়ে পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
ব্যক্তি মর্যাদা: পাহাড়ীদের ব্যক্তি মর্যাদা নেই বললেই চলে। বাঙ্গালীগণ কর্তৃক কথায় কথায় তাচ্ছিল্য করা, ছোট করে দেখা, ইত্যাদি পাহাড়ীদের জন্য খুবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগণ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। বর্তমানে আদিবাসী থেকে তারা রূপান্তরিত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতে। এই সিদ্ধান্ত উপরোক্ত সমস্যাকে আরো তীব্রতর করেছে। আদিবাসী নামে পরিচয় দিতে না পারায় তাদের মধ্যে আছে নৈরাশ্য ও ক্ষোভ। কোন প্রয়োজনে সরকারী অফিস আদালতে গেলে পাহাড়ীরা কোন মর্যাদা পায়না। এমনকি পাবলিক বাসে যাতায়াতকালেও ড্রাইভার ও তার সহকারীরা তাদের তাচ্ছিল্য করে তুই তোকারী করে, মামু বলে সম্বোধন করে।
ভূমি মালিকানা: সহজ সরল পাহাড়ী জনগোষ্ঠী ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে নথিপত্রে বিশ্বাসী নয় এবং বিষয়টি তেমন বোঝেও না। তাদের বিশ্বাস এই জমিতে আমি বংশানুক্রমে বসবাস করছি, জুম চাষ করছি, সুতরাং এই জমির মালিক আমি। ফলে অধিকাংশ পাহাড়ীই কোন নথিপত্র ছাড়াই যুগ যুগ ধরে নির্দিষ্ট জমিতে বসবাস করছে। এই সুযোগে একদল প্রভাবশালী মহল পর্যটন শিল্প, কারখানা, রাবার বাগান ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে পাহাড়ীদের দখলে থাকা ভূমি লিজ নিয়ে নিচ্ছে। উপযুক্ত নথি না থাকায় পাহাড়ীরা এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারছেনা।
উপযুক্ত বিচার: অত্র এলাকার পাহাড়ীদের ন্যায্য বিচার পাওয়া একটি দূরুহ ব্যপার, পর্যবেক্ষনে দেখা যায় বাঙ্গালী সেটলার কর্তৃক হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, উচ্ছেদ হলেও সেই মামলা গ্রহণে অনিহা দেখানো হয় এবং মামলা নেয়া হয় না বরং তাদের পরামর্শ দেয়া হয় স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করে নিতে। অথচ আইনের চোখে এইসব অপরাধ মিমাংসাযোগ্য নয়। অপরদিকে বাঙ্গালী সেটলাররা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে পাহাড়ীদের নামে মামলা মোকদ্দমা করে অবস্থা বিষিয়ে তোলে, যে ব্যাপারগুলোর জন্য মামলার কোন প্রয়োজনই নেই বরং স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করা সম্ভব। ভয় ভীতি, প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে, অর্থাভাব এবং সহযোগিতার অভাবে পাহাড়ীরা আইনের আশ্রয় নিতে পারে না। প্রশাসনও কেন যেন পাহড়ীদের ক্ষেত্রে নীরব থাকছে ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারছে না। থানায় সাহায্য প্রার্থনা করলে পাঠানো হয় সেনাবাহিনীর নিকট আবার সেনাবাহিনী পাঠায় থানায়। এভাবে হেনস্তা হতে হতে একসময় মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যায়, সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তি হাল ছেড়ে দেয়।
চলাচল ও মতামত প্রকাশে স্বাধীনতা: নিরাপত্তার অজুহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক এলাকা সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এইসব এলাকার জনগণ সাধারণ এলাকার মত যে কোন মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমনকি খ্রিস্টান মিশনারী যাজক ও সন্ন্যাসীগণ সংরক্ষিত এলাকা সমূহে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী জনগণের ধর্মীয় যত্ন নেয়া বা উপাসনা পরিচালনার জন্যও যেতে পারেননা। নিরাপত্তার অজুহাতে বিদেশীদের প্রবেশ পার্বত্য অঞ্চলে সীমিত করা হয়েছে। পূর্বানুমতি গ্রহণ একটি জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও পার্বত্য অঞ্চল সফর করতে পারছেনা। ফলে অনেক উন্নয়ন সংস্থাই পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবিক উন্নয়নে পরিচালিত কার্যক্রম গুটিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার পাহাড়ীরা কোন বিদেশীর সাথে একান্তে কথা বলার ক্ষেত্রে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। যদি কথা বলতে হয়, তাহলে সেখানে কোন সরকারী কর্মকর্তার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়।