Skip to content
Home » পাথর গলাতে আর কত অশ্রু প্রয়োজন?

পাথর গলাতে আর কত অশ্রু প্রয়োজন?

দৈনিক জনকন্ঠ, ৮ অক্টোবর রবিবার সংখ্যার প্রথম পাতা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম অফিসে বসে। একটি ছবিতে দৃষ্টি আটকে গেল। অসহায় এক মায়ের কোলে ছোট্ট একটি শিশু, দু’জনেই বৃষ্টিতে ভিজছে, একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে শিশু কন্যাকে বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা রোহিঙ্গা মায়ের! ক্যাপশনে লেখা- উখিয়ার কুতুপালংয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে শিশুকোলে রোহিঙ্গা মায়ের গাছতলায় আশ্রয়। পত্রিকাটা আরেকটু পড়তে চাচ্ছি, কিন্তু ছবিটি থেকে চোখ সরিয়ে সামনে এগুতে পারছিলাম না! বুকের কাছটা কেমন যেন ভারী ঠেকছে। মনে ভেসে আসছে আমরা মেয়ে মিরাবেল-এর মুখটি। ক’দিন বাদেই ওর এক বছর পূর্ণ হবে। মাত্র ও’কে বিদায় জানিয়ে অফিসে এলাম। ছবি’র শিশুটি’র বয়স আমার মিরাবেল-এর কাছাকাছিই হবে। কিন্তু এই শিশুটি’র মুখে হাসি নেই, বরং বৃষ্টি ভেজা যন্ত্রণাকাতর মুখটিতে আছে যেন রাজ্যের অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তা! কি জানি, কি জুটবে এই শিশুর আগামী দিনগুলোতে? বৃষ্টির ঠাণ্ডা কাটিয়ে ছোট্ট শিশুটি সুস্থ থাকবেতো? খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন রাত্রিযাপন করে ও নিরাপদ থাকবেতো? মায়ের কোলে আছে, কিন্তু ও’র বাবা কি বেঁচে আছে? হাজারো প্রশ্ন বার বার খোঁচা দিচ্ছে মাথায়। এত ছোট্ট একটি শিশু, যার বয়স হয়তো এক বছর বা তারো কম, তাকে ঘিরে এত প্রশ্ন কেন করতে হবে ‘মানুষ’কে? এত অনিশ্চিত কেন নিষ্পাপ এই শিশুর ভবিষ্যত?

কিছুদিন আগে সোস্যাল মিডিয়া ‘ফেসবুক’-এ বন্ধু আলজাহিদ সৌরভ তার কোন বন্ধুর পোস্ট করা একটি ভিডিও শেয়ার করেছে- চিৎকার করে ৫-৬ বছরের একটি শিশু কাঁদছে। ভিডিওতে দেখা শিশুটি বাংলাদেশে পৌঁছেছে একেবারেই পরিবারহীন, একা! ভিডিও ধারণকারী বিভিন্নভাবে শিশুটিকে আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাবা-মা’কে হারিয়ে ফেলা, বা হয়তো বাবা-মায়ের মৃত্যু দেখা শিশুটি’র মন কি কোন সান্ত্বনায় আশ্বাস পেতে পারে? সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কিই বা আমরা করতে পারি! ভিডিও’টি দেখার পর থেকেই তার কান্নার শব্দ বারে বারে কানে বাজছে, মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মধ্যেও সে কান্না আমার মস্তিষ্কে বেজে ওঠে, রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়, শিউরে উঠি বারে বারে! কি ভয়ংকর অনিশ্চয়তায়ই না শিশুটি না জানি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কোন এক জায়গায়, হয়তো খুঁজে ফিরছে তার বাবা-মা’কে।

মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনার পেছনে অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষ থাকতে পারে। সেগুলো নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। হয়তো কোন না কোন একদিন সমাধানও আসবে এই মানবেতর সমস্যার। কিন্তু এই শিশুদের মনে যে বিভীষিকা সৃষ্টি হয়েছে, মানুষের প্রতি ভয় ও অবিশ্বাস জন্মেছে, তা হয়তো সারা জীবনেও তারা ভুলতে পারবে না।

পরিসংখ্যান যতদূর জানি, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের প্রায় অর্ধেকের বয়সই ১৮ বছরের নীচে। প্রায় দু’হাজার শিশু বিভিন্নভাবে এ’দেশে এসে পৌঁছেছে একেবারেই একা। হয় তাদের বাবা-মা হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো মারা গিয়েছে! মোহাম্মদ সোহেল তেমনই এক শিশুর নাম। মাত্র ৭ বছর বয়স। জীবনকে এখনো দেখাই শুরু করেনি সোহেল। তার এখন পড়ালেখা আর সুযোগ পেলেই খেলায় মেতে থাকার কথা, ছুটে বেড়ানোর কথা দিনভর। অথচ সোহেল অস্বাভাবিক রকম নীরব, সহজে হাসেনা, সামান্য শব্দেই কেঁপে ওঠে। সোহেল জানেনা কোনদিন সে মায়ানমার থেকে পালিয়েছে, কি তার গ্রামের নাম। সে শুধু এ’টুকুই বলতে পেরেছে, একদিন সকালে সে যখন দাঁত মাজছিলো, তখন সেনারা তাদের গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। “ওরা আমার বাবা, মা, দাদী, আমার বন্ধু সামশু, সামশুর দাদীকে গুলি করেছে” প্রচণ্ড শান্তভাবে কথাগুলো বলা শেষ হতেই সোহেল’র চোখ পানিতে ভরে ওঠে। বড় মর্মান্তিক সোহেল’র চোখে এই পানি দেখা! সোহেল’র অশ্রুসিক্ত এই চোখ দু’টো পাথরের মনকেও বেদনার্ত করে তুলবে! চোখের সামনে পরিবারের সবাইকে মারা যেতে দেখে সোহেল শুধু দৌঁড়েছে, কত ঘন্টা বা কত দিন সোহেল তা জানেনা। একটি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া পর্যন্ত সে দৌঁড়েছে। পরে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাহায্যে ছয়দিন হেঁটে, অভূক্ত অবস্থায়, প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে মোহাম্মদ সোহেল বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়! এটি নাকি ৭ বছরের এক শিশুর গল্প! বিপন্ন মানবতা!

যদি ২,০০০ শিশু একাকী বাংলাদেশে এসে পৌঁছে থাকে, তবে এমন আরো ১,৯৯৯টি গল্প আছে, ১,৯৯৯টি শিশুর চোখ অসহায় অশ্রুতে সিক্ত, ১,৯৯৯টি শিশুর কান্নায় কক্সবাজারের বাতাস ভারী! এই গল্পগুলো কি কোন দিন পৌঁছাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি’র কানে, মায়ানমারের সামরিক জান্তার কানে অথবা বিশ্ব মোড়লদের কানে? এত শিশুদের অশ্রু কি কোনদিন ভেজাতে পারবে তাদের পাথরের মত শক্ত হৃদয়? ঈশ্বর তাদেরকে শোনার শক্তি দিন, বোঝার হৃদয় দিন।

ভবিষ্যত পৃথিবী যেন বলতে শেখে, ‘A child is a child, no matter what.- UNICEF’।

Leave a Reply