Skip to content
Home » প্রাবক্তিক ভূমিকায় কাথলিক ছাত্রবৃন্দ

প্রাবক্তিক ভূমিকায় কাথলিক ছাত্রবৃন্দ

বর্তমান জগতে সেক্যুলারিজম

বর্তমান বিশ্বের চলমান ট্রেণ্ড হচ্ছে ‘সেক্যুলারিজম’। সেক্যুলারিজম একটি দর্শন। এই দর্শন অনুযায়ী জীবনের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয় শুধুমাত্র বৈষয়িক বিশ্বের বিবেচনায়। ধর্মীয় দর্শন এখানে গৌণ, পরিত্যক্ত কিংবা বাতিল। আবার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেক্যুলারিজম এর অর্থ হচ্ছে যে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস বা দর্শনের সাথে রাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক থাকবে না এবং কারো উপরে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়া যাবেনা কিংবা কাউকে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস পালনে বাধা দেয়া চলবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষা প্রচার থেকে বিরত থাকবে এবং ধর্মীয় আইন প্রয়োগ করবে না।

বিশ্ব যখন ক্রমশঃ সেক্যুলার হওয়ার সাধনায় ব্যস্ত, তখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে:

  • পিতা-মাতা যা বিশ্বাস করে, তা সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করতে পারছে না। সন্তানেরা নিজ বুদ্ধিতে ধর্মবিশ্বাস বেছে নেয় বা অবিশ্বাসী হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করে।
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মবিশ্বাস প্রচার ও শিক্ষা থেকে বিরত হচ্ছে।
  • বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে না। 
  • ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মানুষকে ধর্ম পালনে জোরালোভাবে আহ্বান জানাতে পারছে না।
  • ধর্মীয় শিক্ষা ক্রমশ কমে যাওয়ায় ধর্মীয় বিশ্বাসের নিগূঢ় অর্থগুলো মানুষ জানছে না। ফলে ধর্মীয় গ্রন্থ বা শিক্ষায় যা বলা হয়েছে, সেগুলোর প্রতি অবিশ্বাস বাড়ছে।
আজকের পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে, জগতকে ভোগ করতে যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধারণ করা বা না করায় কোন বাধ্য বাধকতা নেই, সেহেতু অনেক মানুষই কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে না এবং ধর্মীয় আচারাদি পালন করছে না। মানুষ এই উপসংহারে আসছে যে, কোন ধর্মীয় বিশ্বাস বড় কথা নয়, জগতের বিষয় ও মানুষই হলো শেষ কথা। সেক্যুলারিজম এর ফল হিসেবে জগতে সৃষ্টি হচ্ছে লিবারিজম (আমি তাই করবো যা আমি চাই) ও এথেইজম (ঈশ্বর বলে কেউ নেই)।

সেক্যুলার জগতে যুবদের ধর্ম বিশ্বাস

সেক্যুলারিজমে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে উঠতে আমরা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি- এই কথা গড়পড়তাভাবে সঠিক ধরে নেয়ার কোন অবকাশ নেই। একদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যেমন যুবরা বয়স্কদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বিশ্বাসী হচ্ছে, অপরদিকে পশ্চিম ইউরোপ, লাটিন আমেরিকা এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে বয়স্কদের তুলনায় যুবদের বিশ্বাস হ্রাসের তেমন চিত্র দেখা যায়না। christianitytoday.com কর্তৃক ১০৬ টি দেশে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৫৮ টি দেশেই বয়স্ক (চল্লিশোর্ধ) ব্যক্তিদের তুলনায় যুবদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস হ্রাসের কোন তারতম্য দেখা যায়না। বাকি ৪৮ টি দেশে বয়স্করা যেভাবে ভাবতো, যুবরা সেভাবে ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে না। যে সমস্ত রাষ্ট্র নিজেদেরকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে, সেগুলোর মধে মুসলিম বা কাথলিক সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্রগুলো অর্থনীতি ও শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি করার পরেও ধর্মবিশ্বাসকে ধারণ করে চলেছে।

আমেরিকা এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশে বয়স্কদের তুলনায় যুবদের ধর্মবিশ্বাসে আগ্রহ কম থাকলেও, এমনো দেশ আছে যেগুলোতে বরং বিপরীত সাক্ষ্য দেখা যায়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানা এবং বিলুপ্ত সোভিয়াত রিপাবলিক হতে উদ্ভুত দেশ জর্জিয়ায় চল্লিশোর্ধ বয়সী মানুষের তুলনায় যুবরা ধর্মকে নিজ জীবনের জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবছে। যেমন ঘানার ৯১ ভাগ যুবরা মনে করে ধর্মবিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বয়স্কদের মধ্যে এই হার ৮৫ ভাগ। ঘানা একটি খ্রিস্টান সংখ্যা গরিষ্ঠ রাষ্ট্র। কিন্তু আফ্রিকার অপর দেশ চাদ হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেখানেও কিন্তু এই হার একই।

তবে যেসব দেশের যুবরা ধর্মবিশ্বাসকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবছে, তারা সবাই যে নিয়মিত মসজিদ বা গির্জায় যায়, তাও ঠিক নয়। বরং ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের হার কমছে। তথাপি জরিপে দেখা গিয়েছে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই দৃষ্টিভঙ্গি আবার বদলে যায়, মানুষ বিশ্বাস পালনে মনযোগী হয়ে ওঠে। যে’সব দেশে শিক্ষা এবং অর্থনীতি ততটা উন্নত নয়, সে’সব দেশের মানুষ যতটা ধর্মবিশ্বাসী; উন্নত দেশগুলোর মানুষ আবার ততটা নয়।

যুবদের বক্তব্যে বিশ্বাস হ্রাস বা বিশ্বাস হারানোর কারণ

The Center for Applied Research in the Apostolate at Georgetown University (CARA) ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করেছে এমন বিভিন্ন বয়সী যুবদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছে। এই জরিপের ফলাফলটি সেন্ট মেরী’স প্রেস কর্তৃক ১৭ জানুয়ারী ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। এই জরিপে কাথলিক ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করেছে এমন যুবদের তিনটি বিভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

  • ক্ষত বহনকারী: এই ভাগে এমন যুবদের রাখা হয়েছে যারা উপলব্ধি করে দুঃখ-কষ্টের সময়ে ঈশ্বর তাদের জীবনে অনুপস্থিত ছিলেন। যেমন: অনেক প্রার্থনা করা সত্ত্বেও হয়তো তাদের বাবা-মা ডিভোর্স নিয়েছে, পরিবারের প্রিয় কোন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছে। একজন যুব সাক্ষ্য দিয়েছে, “আমার দাদু ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। আমরা সবাই তার অরোগ্যের জন্য নিয়মিত প্রার্থনা করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি। আমার দাদু মারা গিয়েছে!”
  • শেকড়ে অসংযুক্ততা: এই ধরণের যুবরা উপলব্ধি করে, বাস্তবিক জীবনের সাথে তাদের কাথলিক পরিচয় বা বিশ্বাসের কোন সংযুক্তি নেই। তারা কেন কাথলিক বিশ্বাসী, তার কোন অর্থ তারা খুঁজে পায়না এবং শেষ পর্যন্ত মণ্ডলীর সাথে সংযুক্তি ত্যাগ করে।
  • ভিন্ন মত পোষণকারী: কিছু যুব কাথলিক মণ্ডলীর শিক্ষার সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে। বর্তমান সময়ে অনেক যুব বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, সমলিঙ্গে বিবাহ, অবাধ যৌনাচার, নারীদের যাজকত্ব, ইত্যাদি বিষয়ে মণ্ডলীর শিক্ষার সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে এবং পরবর্তীতে মণ্ডলী ত্যাগ করে।
গবেষকরা জরিপে আরো যে লক্ষণীয় বিষয়টি পেয়েছেন তা হলো, মণ্ডলী ত্যাগকারী এইসব যুবদের অধিকাংশই কখনোই কাথলিক মণ্ডলী সম্পর্কে তেমন একটা জানতোনা বা নিয়মিত উপাসনায় অংশগ্রহণ করেনি। পক্ষান্তরে মণ্ডলী ত্যাগীদের মধ্যে মাত্র ১৭ ভাগ কাথলিক থাকাবস্থায় নিয়মিত রবিবাসরীয় খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করতো।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাথলিক যুবদের অবস্থা

বৈশ্বিক সেক্যুলারিজমের প্রভাব থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকতে পারেনি। যদিও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র সেক্যুলার নয়, তথাপি আমাদের জীবন ব্যবস্থা সেক্যুলার যা পুঁজিবাদ নির্ভর। পরিবার, সমাজ ও ধর্ম আমাদের মন-মানসিকতা এবং জীবন-যাপনকে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ করে, স্যাটেলাইট এবং ইন্টারনেট তার চাইতে বেশী নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ, উপাসনায় অংশগ্রহণ, সাক্রামেন্ত গ্রহণের চাইতে তাই স্যাটেলাইট টেলিভিশন প্রোগ্রাম এবং ইন্টারনেট কন্টেন্ট আমাদের কাছে বেশী আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।  আবার পুঁজিবাদের প্রচার ও প্রভাব আমাদের সাফল্যকে শুধুমাত্র ভোগবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংজ্ঞায়িত করছে। আমরা স্বপ্ন দেখি বিলাসী জীবন-যাপনের, কিনতে চাই অত্যাধুনিক দ্রব্য সামগ্রী। সাফল্য লাভের প্রস্তুতিতে ক্যারিয়ার চিন্তা আমাদের সবটুকুই জুড়ে আছে। মা-বাবারা যেমন, আমরাও তেমনি ক্যারিয়ার সফলতার জন্য যতটুকু করা দরকার ততটুকুর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। এসবে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে, সামাজিক রীতি-নীতি শিক্ষা ও পালন, ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ, উপাসনায় অংশগ্রহণ, পারিবারিক প্রার্থনা, ইত্যাদির জন্য আমাদের আর কোন সময় থাকছে না। প্রায়ই শোনা যায়, সোমবার স্কুলে ক্লাস টেস্ট আছে, সুতরাং রবিবার বিকালে খ্রিস্টযাগে যাওয়া সম্ভব না। অথবা, খ্রিস্টযাগে যেতে পারছি না, আমার ক্লাস আছে বা টিউশনী করতে যেতে হবে।

সেক্যুলারিজম আমাদের জীবনকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে যে, দুই দশক আগে যা অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল, সেগুলোই এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেমন: ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে বিয়ে (মাণ্ডলীকভাবে বা অবৈধভাবে), বিবাহ বিচ্ছেদ, যত্রতত্র সম্পর্ক গড়ে তোলা ও শারীরিক সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্ক, বছরের পর বছর পুনর্মিলন সংস্কার গ্রহণ না করা ও খ্রিস্টযাগে যোগদান না করা, ব্যাপকহারে মাদকাসক্তি। এই পরিবর্তনগুলো আমাদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে যেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ তেমনি সমাজ ব্যবস্থার সাথেও খাপ খায়না।

কাথলিক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কলা এবং বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ালেখার মানসিকতা দিন দিন শুধু কমছে। এর পেছনেও কারণ আছে। আমরা ক্রমাগত ছুটছি হয় ব্যবসা নয়তো ব্যাংকিং ও কর্পোরেট জব নামক স্বপ্নের পেছনে। সাহিত্য বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় আমাদের কই? এসবে তো অর্থ আসেনা। কেউ বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেও লক্ষ্য শুধুমাত্র ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া! প্রতিভাবান, গবেষক আমরা পাচ্ছিনা। আবার কাথলিক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নৈরাশ্য আছে যে, খ্রিস্টান বলে আমাদের সুযোগ-সুবিধা নেই, আমরা পারবো না। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিসিএস পরীক্ষা, নন-ক্যাডার সরকারী চাকুরী, সামরিক বাহিনী ও পুলিশে যোগদান, এ’সব দিকে কাথলিক ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহের কমতি আছে। রাজনীতি সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদের অত্যন্ত হীন ধারণা। অন্য ধর্মাবলম্বী যুবরা যেভাবে শুভ রাজনীতির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, নতুন কিছু করার ইচ্ছায় হেরে যাওয়া সত্ত্বেও আত্মপ্রত্যয় ধরে রাখছে, সেখানে আমরা সেই সাহসটা এখনো তৈরী করতে না পেরে সমালোচনা এবং তাচ্ছিল্য করে দায় সারছি। এই দূর্বলতাগুলোর কারণে কাথলিক মণ্ডলী হিসেবে কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছাড়া প্রভাবশালী কোন ব্যক্তিকে দেখা যায়না।

অনেক যুবরা অভিযোগ করে কাথলিক মণ্ডলীর শিক্ষা এবং উপাসনায় অংশগ্রহণের সুযোগ নেই, প্রাণ নেই, আনন্দ নেই। একসময় তারা মণ্ডলী ত্যাগ করে অন্য মণ্ডলীতে যুক্ত হয়। এমন যুবদের মধ্যে কাথলিক মণ্ডলী সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান নেই বা আনন্দ প্রাপ্তির জন্য যেভাবে নিয়মিত মাণ্ডলীক রীতি-নীতি বা উপাসনায় যুক্ত থাকার কথা ছিল তাও থাকেনি। কাথলিক মণ্ডলীর কর্তৃপক্ষও যুবদের এই প্রয়োজন পূরণে কার্যকর ও ফলপ্রসূ কোন পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারছে না। ধর্ম সম্পর্কে, বিশ্বাস সম্পর্কে যুবদের মনে হাজারো প্রশ্ন। কারণ তারা আন্তঃমাণ্ডলীক ও আন্তঃধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠছে। বিভিন্ন গঠন কর্মসূচীতে গতানুগতিক একই ধারার শিক্ষা ছাড়া তারা তাদের প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায়না। আমরা আমাদের ধর্মশিক্ষাকে পদ্ধতিগত, যুগোপযোগী এবং আকর্ষণীয় করতে ব্যর্থ হচ্ছি। সেই দূর্বলতার সুযোগে অন্য মণ্ডলী হয়ে ওঠে যুবদের কাছে নতুন পথের দিশা, চাকচিক্যপূর্ণ। ফলে তারা পথ হারায়।

যুবরা বাণী প্রচারে আহুত

যীশু বলেছেন, “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও; বিশ্বসৃষ্টির কাছে তোমরা ঘোষণা কর মঙ্গলসমাচার!” (মার্ক ১৫: ১৬)। সাধু পল তাই আবার বলেছেন, “হায়রে আমি, মঙ্গলসমাচার যদি না প্রচার করি!” (১ করিন্থীয় ৯:১৬)। যুব হিসেবে আমরা যীশুর আহ্বানে আহুত। এখন দায়িত্ব হচ্ছে সাধু পলের উক্তিকে নিজেদের জীবনের উক্তিতে পরিণত করা।

যীশু ঘোষণা করতে বলেছেন ‘মঙ্গলসমাচার’। ঘোষণা’র আগে আমাদের জন্য জরুরী হচ্ছে আত্মগঠন। কাথলিক যুব হিসেবে প্রথমতঃ নিয়ম করে বাইবেল পাঠ করা আমাদের জন্য আবশ্যক। একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে, কত দিনে বা কত মাসে আমি বাইবেলের প্রাক্তন সন্ধি এবং নব সন্ধি পাঠ করা শেষ করবো? প্রতিদিন কতটুকু করে পড়বো? এভাবে একদিন অবশ্যই আমাদের সম্পূর্ণ বাইবেল পাঠ করা শেষ হবে। সম্পূর্ণ বাইবেল পাঠ শেষে আমরা মানুষের জন্য ঈশ্বরের পরিত্রাণ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে সক্ষম হবো। দ্বিতীয়তঃ আমাদের জন্য মণ্ডলীর মূলবান একটি উপহার হচ্ছে ‘কাথলিক মণ্ডলীর ধর্মশিক্ষা’ গ্রন্থটি। আরো আছে এর সংক্ষিপ্তসার গ্রন্থ ‘কম্পেন্দিয়াম’, ‘আমি বিশ্বাস করি’। আছে ইংরেজিতে যুবদের জন্য বিশেষভাবে রচিত ‘YOUCAT’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থগুলো কাথলিক মণ্ডলীর বিশ্বাস সম্পর্কে আমাদের দৃঢ় করে তোলে। তৃতীয়তঃ মণ্ডলীর জন্য যুগান্তকারী ঘটনা হচ্ছে দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা। এই মহাসভা মণ্ডলী ও জীবন সম্পর্কে চারটি সংবিধান, তিনটি ঘোষণাপত্র, নয়টি নির্দেশনামা চূড়ান্ত করেছে। সবগুলো নথিই সংকলিত হয়েছে ‘ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ’ নামক গ্রন্থে। এটি পাঠ করার সুযোগও নিতে হবে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন সময়ে পোপ মহোদয় কর্তৃক বিভিন্ন পালকীয় পত্র, বাণী ইত্যাদি। আমরা যত পাঠ করবো, ধর্মবিশ্বাসের গভীরতা ততটাই বৃদ্ধি পাবে। বাণী প্রচারে ধর্মবিশ্বাসের গভীরতা জরুরী, কারণ ‘One cannot preach until and unless he/she is not convinced and rooted in the faith’।

অন্যের কাছে যীশু খ্রিস্টকে পৌঁছে দেয়ার জন্য মঙ্গলসমাচারের মূল্যবোধকে যুবরা নিজের জীবনের সাক্ষ্য দিয়ে প্রচার করতে পারে। বিভিন্ন পদ্ধতিতেই বাণী প্রচার করা সম্ভব। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন চার্চ খ্রিস্টিয় মূলবোধ প্রচারে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে। খ্রিস্টিয় মূল্যবোধ প্রচার করা যায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে সহভাগিতা করে, কাথলিক প্রতিষ্ঠানে খ্রিস্টিয় জীবন সাক্ষ্য দিয়ে, রেডিও-টেলিভিশন-ইন্টারনেটের মাধ্যমে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং উৎসবের মাধ্যমে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদেরই পছন্দ করে নিতে হবে কোন পদ্ধতি তাদের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত। কিছু বিষয় সহযোগিতার জন্য উল্লেখ করা হলো:

  • একথা নিশ্চয়ই সত্যি যে, যে গ্রন্থগুলোর কথা উপরে উল্লেখ করলাম তা ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। তবে তাই বলে এ’কথাও ঠিক নয় যে আমরা নিজেরা পাঠ করলে কিছুই বুঝতে পারবো না। যতটুকু বুঝতে না পারি, ততটুকু বোঝার জন্য নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সহায়তা করতে প্রস্তুত হবে। আবার আমরা পরস্পর আমাদের ধ্যান ধারণা সহায়তা করার জন্য study session করতে পারি। নিজে শেখা এবং অপরের সাথে সহভাগিতা করার এই ধরণের আয়োজনের উদ্যোগই হতে পারে আমাদের প্রথম বাণী প্রচার।
  • অভিবাসন সমস্যায় যুবরা প্রত্যক্ষভাবে অভিজ্ঞতা করছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে শহরে, দেশে থেকে বিদেশে অভিবাসী হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এই অভিবাসন যুব জীবনে কি ঝুঁকি তৈরী করছে? অনেক যুব পরিবার, সমাজ, মণ্ডলী থেকে দূরে থাকছে। এই যুবরা যে যীশুর ভালবাসার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত নয়, সে সুযোগ তৈরী করে ছাত্র-ছাত্রীরা বাণী প্রচার করতে পারে।
  • মাদকাসক্তি যুবদের মধ্যে আরেকটি প্রত্যক্ষ সমস্যা। আমরা দেখি মাণ্ডলীক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেমন: বড়দিন, পুনরুত্থান, বিভিন্ন সাক্রামেন্ত গ্রহণ উৎসব, ইত্যাদি উপলক্ষ্যে আমাদের আনন্দের উৎস হচ্ছে মদ! আমার বন্ধুদের উৎসবের এই অসুস্থ ধারা থেকে ফিরিয়ে আনা এক ধরণের বাণী প্রচার।
  • বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে দেখি অনেক যুব নিজ মণ্ডলী ত্যাগ করে অন্য মণ্ডলীতে যাচ্ছে, পরে আরেক মণ্ডলীতে যাচ্ছে, পরে আবার অন্য মণ্ডলীতে। কারণ তারা রাতারাতি কোন কিছু দেখতে পাচ্ছেনা, আশ্চর্য কাজ হচ্ছে না, ঈশ্বরের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না! মণ্ডলীগুলো কোন সুপার মার্কেট নয় যে এক দোকানে কিছু না পেলে নিশ্চয়ই তা অন্য দোকানে পাওয়া যাবে। মণ্ডলী ত্যাগে আগ্রহী যুবদের থামিয়ে খ্রিস্টের দেহে সংযুক্ত রেখে ছাত্র-ছাত্রী যুবরা বাণী প্রচার করতে পারে।
  • মিডিয়া এবং ইন্টারনেট যুবদের প্রিয় বিচরণস্থল। কিছু ক্ষেত্রে এগুলো প্রচণ্ডভাবে যুবদের জীবনে অনধিকার হস্তক্ষেপ করে। এই ধরণের মাধ্যমগুলো জীবন সম্পর্কে প্রায়ই ভুল ধারণা তৈরী করে, ভোগবাদে উৎসাহী করে, পর্ণোগ্রাফীতে আসক্ত করে, একাকী থাকার প্রবণতা বাড়ায়। এই বিষয়ে যুবদের সাবধান করা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পবিত্র বাণী প্রচার। শুধু সাবধান করা নয়, ঐ যুবদেরই এমনভাবে প্রভাবিত করা দরকার যেন তারা মিডিয়া এবং ইন্টারনেটকেই বাণী প্রচারে ব্যবহার করতে পারে।
  • নারীদের প্রতি যৌন নিপীড়ণ ও সহিংসতা বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত ব্যাধি। আমাদের যুবকদের মধ্যেই অনেকে নারীদের উত্যক্ত করে আনন্দ পায় অথবা অশ্লীল ছবি বা গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করে, সামাজিক মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে। আমরা যখন ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে বাণী প্রচারে নিয়োজিত হওয়ার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন নিজেরা যেন এই ধরণের বিকৃত অসুস্থতায় আক্রান্ত না হই বা বন্ধুদেরও যেন বিরত রাখি, তা কতইনা সময়োপযোগী বাণী প্রচার হতে পারে!
বাণী প্রচারে যুবদের অংশগ্রহণ এবং সক্রিয়তা যাজক, ধর্মব্রতী বাদ্রার-সিস্টার, কাটেখিস্টদের মতই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ঐশরাজ্যের প্রয়োজনে বাণী প্রচারে যুবদের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

যুবরা সমাজ পরিবর্তনে আহুত

যুবরা শুধু আগামী দিনের ভবিষ্যতই নয়, আজকের পৃথিবীতেও তারা সমাজ পরিবর্তনে বিশাল অবদান রাখছে। তারা এই কাজ করছে হয়তোবা ‘হ্যাশট্যাগ’ এর মাধ্যমে, কোন ইস্যুতে অনলাইনে ‘স্ট্যাটাস’ দিয়ে বা ‘ব্লগ’ লিখে, অথবা কোন ‘প্রতিবাদ’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। অনেক পথ আছে, যার মাধ্যমে যুবরা পৃথিবীর সামাজিক পরিবর্তনে ‘ভিন্নতা’ আনতে সক্ষম।

  • স্বেচ্ছাসেবা: অনেক যুব, বিশেষভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্নভাবে স্বেচ্ছাসেবা দান করছে। এটি শুধু সি.ভি. তে লেখার জন্য কিছু যোগ্যতা অর্জন নয়, বরং আরো বড় কিছুর জন্য প্রত্যাশা। স্বেচ্ছাসেবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে: শিক্ষা দানে, খেলোয়াড় প্রশিক্ষক হিসেবে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কাজে, সচেতনতামূলক কার্যক্রমে। দূর দেশে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবার চাইতে ফলপ্রসূ হচ্ছে যেখানকার ইস্যু, সেখানে সেবাদান, নিজের সমাজে সেবাদান। স্বেচ্ছাসেবা দানে খুঁজে দেখতে হবে আমার সমাজে ও এলাকায় কি সমস্যা আছে? সেখানে আমি কিভাবে অবদান রাখতে পারি? আমার পক্ষে কি করা সম্ভব?
  • সমস্যা তুলে ধরা: আমাদের এলাকায় বিভিন্ন ধরণের সমস্যা আছে। সামাজিক সমস্যা, নাগরিক সমস্যা ইত্যাদি। এসব সমস্যা তুলে ধরার হয়তো কেউ নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে, যেমন: জনপ্রতিনিধিকে (কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেয়র, সংসদ সদস্য) লিখিতভাবে জানানো, পত্রিকায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখা দেয়া। এই পদ্ধতিতে হয়তো একদিনেই কোন সমাধান হবেনা, তবে পরিবর্তনের সূত্রপাত এভাবেই হয়।
  • অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করা: অতীতে কোন সময়েই বর্তমানের মত লক্ষ লক্ষ্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর কোন পন্থা ছিলনা। আমরা জানি কিভাবে একটি সাধারণ টুইটার হ্যাশট্যাগ বা ফেসবুক স্ট্যাটাস বিশাল সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। আমরা ভেবে দেখতে পারি কোন ইস্যুতে আমি কি হ্যাশট্যাগ এবং স্ট্যাটাস লিখতে পারি?
  • যদি কারো লেখালেখির অভ্যাস থাকে, যা ছাত্রদের কাছে প্রত্যাশিত, তবে সে অনলাইনে ব্লগার হতে পারে, কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখালেখি করতে পারে। যাদের ব্লগিং করে অভ্যাস আছে, তারা জানে কিভাবে একটি লেখা হাজারো মানুষের কাছে নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছে।
  • অন্য যুবদের সংযুক্ত করা: পরিবর্তন আনার চমৎকার একটি পদ্ধতি হচ্ছে কোন ইস্যুতে নিজের কার্যক্রমে অন্য যুবদের যুক্ত করা। এতে করে একজন ছাত্র শুধু কোন ইস্যুতে অন্য যুবদের শিক্ষাই দিচ্ছেনা, বরং ক্ষমতায়ন করছে যেন অন্য যুবরাও অন্যদেরকে শিক্ষা দিতে ও সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়। আমরা আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠান দেখি যারা তাদের কার্যক্রমের জন্য ‘ইয়ুথ এ্যাম্বাসেডর’ নিয়োগ করে। একই কাজ ছাত্ররাও করতে পারে। মনে করি কোন ছাত্র কোন সামাজিক ইস্যুতে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করতে চায়, কিন্তু তা করতে অনেকের সাহায্য লাগবে। তখন সমমনা ছাত্র ও যুবদের একটি দল তৈরী করা যায়, যাদের প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে ঐ ক্যাম্পেইনের এ্যাম্বাসেডর হতে পারে। এভাবে ছাত্ররা অন্য যুবদের নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
  • বৃত্তের বাইরে চিন্তা করা: কেন ইন্টারনেটে কোন ভিডিও, ক্যাম্পেইন বা ছবি ভাইরাল হয়? এর কারণ হলো হয়তো সেগুলো এমন কোন ঘটনা, বিষয় বা ইস্যুকে কেন্দ্র করে, যেগুলো ‘শেয়ার’ করার মত কন্টেন্ট হয়ে ওঠে। সমাজে ভিন্নভাবে পরিবর্তন আনার জন্য সৃষ্টিশীল ও অনন্য পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সক্ষমতা ছাত্র-ছাত্রীদের আছে।
  • নারী অধিকার সংরক্ষণ করা: যদি সব নারী শিখতে, উপার্জন করতে এবং স্বাধীনতা লাভ করতে পারে, তাহলে ফলাফল হবে অচিন্তনীয় এবং বৈপ্লবিক। নারী শক্তির সম্ভাবনাকে উন্মোচন করার মানসে সমাজে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে ছাত্র-ছাত্রীরা নিশ্চয়ই সক্ষম।
ব্যক্তি এবং সমাজের মধ্যে সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করা ছাত্রদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। মানুষ একটি সমাজের অংশ এবং ছাত্ররা এই পরিধির বাইরে নয়। ছাত্ররা সামাজিক সংঘবদ্ধ জীবন থেকে একেবারে আলাদা হয়ে থাকতে পারেনা। এমনকি স্কুল পড়ুয়া একজন ছাত্রকেও সমাজের অন্যদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়, যারা একত্রে মিলেই সেই সমাজটা গঠন করে। এই সমাজকে উন্নত এবং শক্তিশালী করতে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। সহজ বিষয় হলো, united we stand and divided we fall।

সমাজ হলো এই একতাবদ্ধ জীবনের বাহ্যিক প্রকাশ। তাই সকল বয়স ও পেশার নারী-পুরুষের সমাজকে সেবা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা উচিত। ছাত্রদের জীবনের মূল কাজ হলো শিক্ষা গ্রহণ। কিন্তু যৌবন এবং উদ্যমতার তাড়নায় অতিরিক্ত সময়ে তারা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে, যেমন: সাক্ষরতা অভিযান, বয়স্ক শিক্ষা, রক্তদান কর্মসূচী, পথশিশুদের জন্য শিক্ষা, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা, অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জনমত তৈরী, মাদকবিরোধী কার্যক্রম, প্রাকৃতিক দূর্যোগে আর্তমানবতার সেবা, ইত্যাদি। আমাদের কাথলিক ছাত্র-ছাত্রীরা ইতোমধ্যে এই সামাজিক সাক্ষ্যদান করছে, যা আমাদের মনে আশার সঞ্চার সৃষ্টি করে।

Leave a Reply