Skip to content
Home » খ্রিস্টবিশ্বাসের তীর্থযাত্রায় দিয়াঙ; ১৫১৮-২০১৮: এক মহাকাব্যিক উপাখ্যানের নাম

খ্রিস্টবিশ্বাসের তীর্থযাত্রায় দিয়াঙ; ১৫১৮-২০১৮: এক মহাকাব্যিক উপাখ্যানের নাম

২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, বাংলার খ্রিস্টভক্তদের জন্য এক অনুগ্রহের বর্ষ! চট্টগ্রাম তথা পূর্ববঙ্গে ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টবিশ্বাস আগমনের গৌরবময় পাঁচশত বর্ষ পূর্তি। চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটান আর্চবিশপ অনুগ্রহধন্য বর্ষটিকে তাই ঘোষণা করেছেন- ‘প্রেরণ বর্ষ’ রূপে।

খ্রিস্টবিশ্বাস আগমনের গোড়ার দিকের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে ‘দিয়াঙ’ নামটিকে কোনভাবেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়না। যদিও ধর্মপল্লী হিসেবে দিয়াঙ-কে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মাত্র কয়েকবছর পূর্বে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে।

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের পর্তুগীজ সাহিত্যে একটি নাম বারে বারে ঘুরে ফিরে এসেছে- ‘সিটি অব বেঙ্গালা’। যদিও পর্তুগীজ বণিকেরা ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিয়মিত বাংলার সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তথাপি ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে ভার্থেমা নামে একজন অভিযাত্রী এই শহরে অর্থাৎ ‘সিটি অব বেঙ্গালা’য় আসার কথা উল্লেখ করেছেন। আফ্রিকা ও ভারতীয় উপকূলের মানচিত্র প্রথম যারা এঁকেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম দুয়ার্তে দ্য বারবোসা। তিনি বলেছেন “এই সাগর (বঙ্গোপসাগর) একটি উপসাগর, যা উত্তরদিকে প্রবেশ করেছে। সাগরের ভেতর দিকে মুসলিম অধ্যুষিত এবং চমৎকার বন্দর সমৃদ্ধ একটি বিরাট শহর আছে, যার নাম বেঙ্গালা।” তিনি বেঙ্গালা বলতে বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের এলাকাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু পর্তুগীজ লেখকেরা চাটিগাম অর্থাৎ বর্তমান চট্টগ্রামকে বেঙ্গালার একটি শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং মানচিত্রে এর অবস্থান দেখিয়েছেন চাটিগামের আরো দক্ষিণে। এ’কারণে ফাদার হস্টেন নামক একজন মিশনারী ভুল করে সিদ্ধান্তে আসেন যে, বেঙ্গল উপসাগরে দিয়াঙ হচ্ছে প্রথম পর্তুগীজ বসতি এবং একে পোর্তো গ্রান্দে অর্থাৎ পোতাশ্রয় নামে ডাকা হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পোর্তো গ্রান্দের অবস্থান ছিল বর্তমান চট্টগ্রামে। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে দ্য বারোজ নামে একজন অভিযাত্রী চাটিগামকে তার আঁকা মানচিত্রে অন্তভূর্ক্ত করেছিলেন, কিন্তু সেখানে সিটি অব বেঙ্গালা ও দিয়াঙের কোন উল্লেখ ছিলনা। ওভিংটন নামে অপর একজন অভিযাত্রী ভুল বোঝাবুঝিটিকে পরিষ্কার করে চাটিগাম বা চট্টগ্রামকে সিটি অব বেঙ্গালা হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং বলেছেন পর্তুগীজ লেখকেরা সিটি অব বেঙ্গালাকে প্রকৃত অবস্থানের চাইতে আরো দক্ষিণ দিকে দেখিয়েছে।

তথাপি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে দিয়াঙে যে খ্রিস্টভক্তদের বসতি গড়ে উঠেছিল এ’ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গে প্রথম মিশনারী হিসেবে আসেন জেজুইট সম্প্রদায়ের ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্ণান্দেজ এবং ফাদার ডমিঙ্গো ডি সুজা। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্ণান্দেজের দিয়াঙে যাওয়ার ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় যা নিশ্চিত করে দিয়াঙে যেহেতু পর্তুগীজ খ্রিস্টভক্তদের বসতি ছিল, তার যাওয়াটা প্রয়োজনীয় ছিল। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর তিনি দিয়াঙ থেকে কোচিন ডাইয়োসিসে পাঠানো একটি চিঠিতে দিয়াঙকে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তখন থেকেই দিয়াঙ পর্তুগীজ ইতিহাসে গুরুত্ব পেতে শুরু করে এবং ফিরিঙ্গি বন্দর নামে পরিচিতি পায়। এই ফাদার ফ্রান্সেসকো যখন দেখলেন আরাকানরা বহু পর্তুগীজ শিশু ও নারীদের দাস হিসেবে বন্দী করে রেখেছে, তখন তিনি জোরালো প্রতিবাদ করেন। ফলস্বরূপ তাকে ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে গ্রেপ্তার করা হয়, একটি চোখ উপড়ে ফেলা হয়। তিনি বন্দী অবস্থায় মৃতুবরণ করে বাংলার প্রথম খ্রিস্টশহীদ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান। দিয়াঙ নামটি এখনো টিকে আছে দিয়াঙ পাহাড়ের পাদদেশে, যা কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর ধরে তিন মাইল ব্যাপী শৈলশিরা জুড়ে বিস্তৃত। দিয়াঙ তখন ছিল আরাকান সাম্রাজ্যের অধীনস্ত। ফাদার ফার্ণান্দেজ দিয়াঙে বহু পর্তুগীজ বসবাসের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। পর্তুগীজরা আরাকান রাজার কাছে গির্জা নির্মাণের জন্য একখণ্ড জমি দাবী করলে তাদের তা দেয়া হয়। পর্তুগীজদের আমন্ত্রণে ডমিনিকান সন্ন্যাস সংঘের দু’জন যাজক ফাদার গ্যাসপার দ্য এসাম্পসন এবং ফাদার বেলচিয়র দ্য লুজ ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে দিয়াঙে যান এবং সেখানে ৩২০০ বর্গফুটের একটি গির্জা ও একটি আশ্রম স্থাপন করেন। এই গির্জাটি চট্টগ্রামে নির্মিত তৃতীয় গির্জা। কিন্তু যুদ্ধের সময় আগুন লেগে মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই এই গির্জাটি ধ্বংস হয়ে যায়। চট্টগ্রাম ও দিয়াঙে অবস্থানরত পর্তুগীজদের প্রতি আরাকান রাজ ১৬০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু পর্তুগীজরা ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে বাকলা’র রাজা’র কাছ থেকে সদ্বীপ দখল করে নিলে আরাকান রাজের সাথে মানসিক শত্রুতা শুরু হয়। তিনি পর্তুগীজদের নিজের রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে ভাবতে শুরু করেন।

ফিলিপ্পি দ্য ব্রিটো ই নিকোতে নামক একজন পর্তুগিজ যোদ্ধা আরাকান রাজ সালিম শাহকে সহযোগিতা করে টাঙ্গুর রাজার সাথে যুদ্ধ করে ‘পেগু’ নামক স্থানটি আরাকান রাজের দখলে এনে দেয়। ফলে নিকোতে আরাকান রাজের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে নিকোতে পর্তুগীজ সম্রাট কর্তৃক পেগু দখলের সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পান। সালভাদর রিবেইরো ডি’সুজা নামে অপর একজন যোদ্ধা আটমাস যুদ্ধ শেষে রাজা সালিম শাহকে পরাজিত করে পেগু দখল করেন। পরে নিকোতে রাজা হিসেবে পেগু তথা মাসিঙ্গার রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্রিটো ই নিকোতে তার ছেলেকে আরাকান রাজার কাছে পাঠিয়ে দিয়াঙ বন্দরের ইজারা দাবি করেন। কিন্তু আরাকান রাজ কৌশলে নিকোতের ছেলে ও সঙ্গে আসা সকলকে দরবারে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। এরপরেই আরাকান রাজ দিয়াঙে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী ছয়শত পর্তুগীজ নারী, পুরুষ ও শিশুকে ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেন, যারা কোনভাবেই নিকোতে’র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলনা। আরাকান রাজার আক্রমন থেকে এ’সময় সেবাস্তিয়াও গনজালেস তিবাউ নামে একজন পর্তুগীজ প্রায় ১০ জনের মত পর্তুগীজকে নিয়ে দিয়াঙ থেকে পালাতে সক্ষম হন। তিবাউ পরে পর্তুগীজ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং দিয়াঙে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিশোধ নেন। পর্তুগীজরা পুণরায় দিয়াঙে ফিরে আসে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের পরে। এ’সময় পর্তুগীজ অভিযাত্রীরা আরাকান রাজের কর্মী হিসেবে নিয়োগ পেতে থাকে। সালিম শাহ মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য পর্তুগীজদের সহায়তা ব্যবহার করতে থাকে। ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ফিরে আসা পর্তুগীজদের বসতির সাক্ষ্য হচ্ছে দিয়াঙের বর্তমান খ্রিস্টান পাড়া। খ্রিস্টান পাড়া সন্নিকটে একটি কবরস্থান আছে যা পুরাতন কবরস্থান নামে পরিচিত। এই কবরস্থানেই ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্মশহীদ হওয়া খ্রিস্টভক্তদের মৃতদেহ পুঁতে রাখা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে।

১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ সালিম শাহ জানতে পারেন পর্তুগীজরা তার রাজ্য দখল করার জন্য গোপনে মুঘল সম্রাটের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তিনিও গোপনে পর্তুগীজদের আক্রমন করে দিয়াঙ বন্দর হতে উৎখাতের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রস্তুতির সংবাদ কোনভাবে দিয়াঙের পর্তুগীজরা জেনে যায়। তখন দিয়াঙে ফাদার মানরিক নামে একজন ধর্মযাজক সেবা দিচ্ছিলেন। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই মা-মারীয়া’র সাক্ষাৎকার পর্বের দিন তিনি আরাকান রাজার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে দিয়াঙ বন্দর থেকে গেলিয়া নামক একটি জাহাজযোগে আরাকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ’সময় আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড দুর্যোগপূর্ণ। কুতুবদিয়া চ্যানেল, মাতামুহুরী নদী অতিক্রম করে তৃতীয় দিনে তারা রামু পৌঁছান যেটি বর্তমানে কক্সবাজার জেলার অন্তভর্‚ক্ত। ফাদার মানরিক রামুকে একটি শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে তারা জাহাজ থেকে নামতে পারেননি। সম্ভবতঃ তারা বাকখালী নদী অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছান। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তারা কক্সবাজার জেলার গর্জনিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন। জাহাজযোগে আর যাওয়া সম্ভব না হলে তারা হাতিতে করে স্থলপথে যাত্রা শুরু করেন ৮ জুলাই তারিখে। সেখান থেকে টেকনাফ হয়ে তারা আরাকান পৌঁছান। এই পথটি যুবরাজ সুজা আরাকানদের সাথে যুদ্ধে ব্যবহার করতেন। ফাদার মানরিক রাজাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পর্তুগীজরা তার রাজত্বের জন্য কোন হুমকি আনবে না। আগস্টিনিয়ান সন্ন্যাসী ফাদার সেবাস্টিয়ান মানরিক ১৬২৯-১৬৩১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে দিয়াঙে ছিলেন এবং আরাকানসহ বহু এলাকা সফর করেছেন। এ’সময় তার সঙ্গী হিসেবে আগস্টিনিয়ান সম্প্রদায়ের আরো দু’জন যাজক ছিলেন- ফাদার মানুয়েল দ্য ল্য কন্সেপশন এবং ফাদার ডিয়োগো ক্যোলান। এই তিনজন ফাদার ঐ’সময়ে দিয়াঙ ও চট্টগ্রামে ১১,৪০৭ জনকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। ফাদার মানরিক এ’সময় ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে ডমিনিকান ফাদারগণ কর্তৃক নির্মিত গির্জাটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। যোড়শ শতকে দিয়াঙে আর যে’সব যাজক সেবা দিয়েছেন বলে জানা যায়, তারা হলেন- ফাদার ব্লেইজ নিউন্স (১৬১২), ফাদার কাপুট্টি (১৬১৭) এবং ফাদার জিন ক্যাব্রাল (১৬২০)।

ষোড়শ শতকের পর থেকে দিয়াঙে খ্রিস্টানদের পালকীয় ও সাক্রামেন্তীয় যত্নে কোন সম্প্রদায়ের কোন যাজক ছিলেন বা আদৌ কেউ ছিলেন কি না সেই ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়না। তবে চট্টগ্রাম থেকে ফাদারগণ এসে স্থানীয় খ্রিস্টানদের যত্ন নিতেন, এমন ঐতিহাসিক বিবরণ আছে। পবিত্র ক্রুশ সংঘের একজন মিশনারী হিসেবে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আসেন ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল হিসেবে চট্টগ্রামে আঘাত হানে- বেঙ্গল ফেমিন- প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার লোক না খেয়ে মারা যেতে থাকে চট্টগ্রামে। অর্থনৈতিকভাবে সমাজের নীচের সারিতে থাকা জেলে সম্প্রদায় এই দুর্ভিক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জেলেদের সহায়তায় তিনি চট্টগ্রামের চাক্তাই নামক এলাকায় কর্ণফুলী নদীর তীরে আশ্রয় ক্যাম্প ও খাবার ব্যবস্থা করেন। অসামান্য অবদানের জন্য বৃটিশ সরকার ব্রাদার ফ্লেভিয়ানকে ‘কাইসার-ই-হিন্দ’ পদক প্রদান করেন। দুর্গত জেলেদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় সরকার তাকে ‘লিয়াসন অফিসার’ নিয়োগদান করেন।

আশ্রয় ক্যাম্পে তিনি অনেক জেলে শিশুকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন, যাদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকেরা মারা গিয়েছে। এই শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে ব্রাদার ফ্লেভিয়ান চিন্তিত হয়ে পড়েন। সেই থেকে তার জীবন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এই সময় ফাদার বার্ট্রাণ্ড রড্রিক্স ব্রাদার ফ্লেভিয়ানকে নিয়ে দিয়াঙের খ্রিস্টান পাড়া সফরে যান। তখন দিয়াঙের বর্তমান অবস্থান অর্থাৎ মারীয়া ও যোসেফ পাড়া ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দিয়াঙের বর্তমান জায়গা কিনে নিয়ে তিনি সামাজিক উন্নয়ন কাজ শুরু করেন, গড়ে তোলেন দিয়াঙের বর্তমান অবস্থানকে। চাক্তাই থেকে ২০০ অনাথ শিশুকে নিয়ে এসে তিনি সেখানে অনাথ আশ্রম স্থাপন করেন ১৯৪৫-১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে, ব্যবস্থা করেন খাদ্য, শিক্ষা ও কারিগরী প্রশিক্ষণের। এছাড়াও শিশুদের পারিবারিক মমতায় দেখাশোনা করার জন্য বেশ কয়েকটি জেলে পরিবারকে তিনি দিয়াঙে নিয়ে আসেন।

ব্রাদার গডফ্রে ডেনিস, সিএসসি’র সহায়তায় ব্রাদার ফ্লেভিয়ান অনাথ জেলে শিশু ও স্থানীয় শিশুদের শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে মরিয়ম আশ্রম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্কুলটি মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে উন্নীত হয়। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কয়েক বছরের জন্য ব্রাদার ফ্লেভিয়ান দিয়াঙ থেকে নোয়াখালী বদলী হন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আবারো ফিরে আসেন ও বাকি জীবন দিয়াঙে সেবাকাজ করেন। ঐ বছরই তিনি দিয়াঙকে মরিম আশ্রম নাম দেন। এরপর থেকে শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ক বিভিন্ন সামাজিক কাজে তিনি মনযোগী হন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে নারী স্বনির্ভরতার উদ্দেশ্যে পবিত্র ক্রুশ সংঘের সিস্টারদের সহযোগিতায় সেলাই ও হস্তশিল্প শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেন। গৃহনির্মাণ প্রকল্প, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, সমবায় সমিতি ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করে তিনি ভাগ্যপীড়িত জেলেদের উন্নয়ন করে যেতে থাকেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কালিদহ ফিশিং প্রজেক্ট আরম্ভ করেন। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তিনি জেলেদের যন্ত্রচালিত নৌকা বানানো ও মেরামতের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর জন্মভূমি কানাডায় পঞ্চম ও শেষবার ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসে তিনি সামাজিক সেবা কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং পবিত্র ক্রুশ সংঘের ব্রাদারদের বাড়ী থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে আশ্রম স্থাপন করে আশ্রমিক জীবন গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর তিনি আশ্রমে মা-মারীয়ার গ্রোটো নির্মাণ করেন এবং পরবর্তী বছর ১১ ফেব্রুয়ারী তারিখে লুর্দের রাণী মা-মারীয়ার পর্ব আয়োজন করেন। এই পর্বে ৮০০ খ্রিস্টভক্ত যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের তৃতীয় বিশপ প্রয়াত যোয়াকিম রোজারিও, সিএসসি মরিয়ম আশ্রমকে তীর্থস্থানরূপে স্বীকৃতি দান করেন। সেই থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতি ও শুক্রবার দিয়াঙে মা-মারীয়া’র তীর্থোৎসব পালিত হয় যেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার খ্রিস্টভক্ত অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ফাদার রেমণ্ড ড্যুজারিয়ে, প্রাদো; ফাদার বেলোনী, পিমে দিয়াঙ আশ্রমের আশ্রম গুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে দায়িত্বে আছেন বর্ষীয়ান ব্রাদার লরেন্স ডায়েস, সিএসসি। মোটামুটি সত্তরের দশক থেকে চট্টগ্রাম হতে ফাদারগণ এসে নিয়মিত দিয়াঙে খ্রিস্টযাগ অর্পণ করতেন। আরো পরে স্থায়ীভাবে ফাদারগণ দিয়াঙে থাকতে শুরু করেন।

১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুন ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত, সিএসসি মৃত্যুবরণ করেন এবং শেষ ইচ্ছানুযায়ী দিয়াঙের বর্তমান গির্জার পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে দিয়াঙে’র অনেক জায়গা কোরিয়ান রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে ঐতিহাসিক এই ভূমির বহু জায়গা হারায় মণ্ডলী, ক্ষতিগ্রস্থ হয় বসবাসরত বহু পরিবার। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে মরিয়ম আশ্রম দিয়াঙকে ধর্মপল্লীতে উন্নীত করা হয় এবং ব্রাদার ফ্লেভিয়ানকে ঈশ্বরের সেবক ঘোষণা দানের মাধ্যমে ধন্য শ্রেণীভূক্তকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে দিয়াঙে দ্বিতল গির্জা ঘর আশীর্বাদ ও উদ্বোধন করা হয়।

খ্রিস্টবিশ্বাসের তীর্থযাত্রায় পাঁচশত বর্ষ পেরিয়ে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দকে চট্টগ্রাম আর্চডাইয়োসিস ‘প্রেরণ বর্ষ’ রূপে ঘোষণা করেছে। পাঁচশত বর্ষ পূর্তির উৎসব আগামী ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। শত খ্রিস্টশহীদের রক্তে স্নাত পুণ্যভূমি দিয়াঙকে এই উৎসবের জন্য স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে দিয়াঙ থেকে চট্টগ্রামে প্রেরণ কাজের নবজাগরণের যাত্রা শুরু হবে, এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

—-
তথ্যসূত্র:
১. হিস্টরি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল- যোয়াকিম যোসেফ এ. ক্যাম্পোস, বাটারওয়র্থ এণ্ড কোং লিঃ, কলকাতা, ১৯১৯।
২. হিস্টরি অব আরাকান: পাস্ট এণ্ড প্রেজেন্ট- ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস, ১৯৯৪।
৩. ল্য পাইয়্যোর, ভলিউম ২- আর্কাইভ, চট্টগ্রাম কাথলিক আর্চডাইয়োসিস।
৪. এ হিস্টরি অব চিটাগং, ভলিউম ১- সুনিতি ভূষণ কানুনগো, এম.এ.; পি.এইচ.ডি., সিগনেট লাইব্রেরী, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম, ১৯৮৮।
৫. বাংলাদেশে কাথলিক মণ্ডলী- যেরোম ডি’কস্তা, প্রতিবেশী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৮।

Leave a Reply