একটি ডাইয়োসিসের পালকীয় সেবাকর্মী হিসেবে সেবারত থাকায় বিভিন্ন মতাবলম্বী ও ধরণের মানুষের সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে। বিশেষভাবে আন্তঃমাণ্ডলীক পরিমণ্ডলে যখন অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ ঘটে, বিভিন্ন মণ্ডলীর সভ্যদের মধ্যে একটি ধারণা দেখি যে, অনেকেই ভাবে কাথলিক খ্রীষ্টভক্তবৃন্দ বাইবেল পড়েনা। এই মতবাদে আমাদের কাথলিকদের অনেকেই কিন্তু সমর্থন জানায়! কিছু ক্ষেত্রে আমি এমনও বলতে শুনেছি যে, কাথলিক মণ্ডলী বাইবেল পড়তে নিরুৎসাহিত করে এবং কর্তৃপক্ষ বাইবেলের সত্যসমূহ সাধারণ খ্রীষ্টভক্তদের কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়!
খ্রীষ্টযাগে কাথলিকগণ বাইবেল পড়ে
কাথলিক মণ্ডলী ক, খ, গ তিনটি পূজণবর্ষে তিন বছর সময়ব্যাপ্তীতে প্রায় সম্পূর্ণ বাইবেল পাঠের ব্যবস্থা রেখেছে। রবিবারে খ্রীষ্টযাগে তিনটি এবং অন্যান্য দিনে দুইটি শাস্ত্রপাঠ নেয়া হয়। রবিবার দিনে প্রাক্তন সন্ধি (পুরাতন নিয়ম) থেকে একটি, নবসন্ধি (নতুন নিয়ম) থেকে একটি এবং মঙ্গলসমাচার থেকে পাঠ বেছে নেয়া হয়। এই তিনটি পাঠই কিন্তু একটি ‘মূলসুর’কে কেন্দ্র করে নির্ধারিত হয়। যাজক এই মূলসুর অথবা সরাসরি শাস্ত্রপাঠকে ভিত্তি করে খ্রীষ্টভক্তদের উপদেশ প্রদান করেন। অন্যান্য দিনের খ্রীষ্টযাগে সাধারণত পুরাতন নিয়ম থেকে একটি পাঠ এবং একটি মঙ্গলসমাচার পাঠ করা হয়। কাথলিকদের সর্বোচ্চ উপাসনা খ্রীষ্টযাগে এ’ভাবেই তিন বছরে প্রায় সম্পূর্ণ বাইবেল পাঠের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এছাড়াও খ্রীষ্টযাগে প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে সামগান করে খ্রীষ্টভক্তগণ পবিত্র শাস্ত্র শুধু পাঠই করেনা বরং গায়ও। খ্রীষ্টযাগ ব্যাপী যে ধর্মীয় গান করা হয়, তার অধিকাংশই বিভিন্ন বাইবেলের উক্তি’কে কেন্দ্র করে লিখিত হয়েছে।
বাড়ীতে কাথলিকগণ বাইবেল পড়ে
একথা সত্যি যে, অনেক খ্রীষ্টভক্তই বাড়ীতে নিজে নিজে বাইবেল পড়েনা; তবে এ’কথা আবার সকল কাথলিকদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। এই ধারণাও ঠিক নয় যে মণ্ডলী বাইবেল পাঠকে নিরুৎসাহিত করে! বরং সেই পঞ্চম শতাব্দীতে সাধু জেরম বলেছেন, “শাস্ত্র সম্পর্কে মূর্খতা হচ্ছে, খ্রীষ্ট সম্পর্কে মূর্খতা”।
ব্যক্তিগত প্রার্থনা, ধ্যান এবং অন্যান্য সময়ে বাইবেল পাঠের জন্য মণ্ডলী সবসময়ই খ্রীষ্টভক্তদের প্রেরণা দান করে। আমাদের দেশের সকল ডাইয়োসিসে পালকীয় পদ্ধতি হিসেবে ‘ক্ষুদ্র খ্রীষ্টিয় সমাজ’কে গ্রহণ করা হয়েছে সেই আশির দশকে। ক্ষুদ্র খ্রীষ্টিয় সমাজ হচ্ছে পবিত্র শাস্ত্রের আলোকে স্থানীয় সমাজকে গড়ে তোলা ও সক্রিয় রাখা, যেখানে পবিত্র শাস্ত্রই হচ্ছে খ্রীষ্টভক্তদের জীবন-যাপনের নির্দেশিকা! এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে লেকসিও ডিভিনা প্রার্থনা ছাড়াও নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাইবেল স্টাডি মিটিং। প্রাহরিক প্রার্থনা’র মূল এবং একমাত্র বিষয়বস্তুই হচ্ছে পবিত্র শাস্ত্র!
কাথলিকগণ শুধু বাইবেল পড়েই না, কিন্তু একে অত্যন্ত পবিত্রতা ও মর্যাদার সাথে গণ্য করে। খ্রীষ্টযাগে’র মূল দুইটি অংশের মধ্যে প্রথম অংশটিই হচ্ছে ‘বাণী উপাসনা’ এবং তা খ্রীষ্টযাগের অর্ধেক অংশ জুড়ে ব্যপৃত। বিভিন্ন উপাসনায় যাজক যে প্রার্থনা বলেন বা খ্রীষ্টভক্তগণ যে উত্তর দেন, যে সমস্ত আচারাদি করা হয়, তার সবকিছুই কিন্তু সরাসরি পবিত্র শাস্ত্রকে ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয়েছে। কাথলিক মণ্ডলী বাণী উদযাপন করে, বাণী যাপন করে এবং বাণী’র আলোকে সমস্ত কিছু শিক্ষা দান করে।
কেন ভুল ধারণা?
কাথলিকরা বাইবেল পড়েনা, অন্য মণ্ডলী’র সভ্য বা আমাদের মধ্যে এই ধারণা গড়ে ওঠার পেছনে কিছু কারণ অবশ্য আছে।
এ’কথা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য যে, বেশীরভাগ কাথলিকদের মধ্যে পবিত্র বাইবেল সম্পর্কে খুব কম ধারণা আছে। এটি দুঃখজনক, কিন্তু বাস্তবতা! সকল খ্রীষ্টভক্তদের অবশ্যই বাইবেল আরো বেশী পড়া উচিত, শুধুমাত্র খ্রীষ্টযাগ ও আর প্রার্থনায় নয়, বরং ব্যক্তিগতভাবেও।
অন্যান্য বিভিন্ন মণ্ডলীর সভ্যদের অনেকে পবিত্র শাস্ত্র থেকে অধ্যায় ও পদসহ মুখস্ত বলতে পারে। এটি নিংসন্দেহে একটি ভাল অভ্যাস, কাথলিকরাও যদি তা করে তো চমৎকার হয়। তবে কাথলিক মণ্ডলী বাইবেলের অধ্যায় ও পদসহ মুখস্ত করাকেই চূড়ান্ত বলে মনে করেনা, বরং জীবনকে পবিত্র শাস্ত্রের শিক্ষা অনুযায়ী রূপান্তর করাটাকেই বেশী প্রাধান্য দেয়। মুখস্ত করার সংস্কৃতি না থাকায় কোন অধ্যায়ের কোন পদে যীশু কি বলেছেন, আমরা হয়তো চট করে তা খুঁজে পাইনা, বলতেও পারিনা। তথাপি এর অর্থ এই নয় যে, আমরা বাইবেল পড়ি না। আবার এই কথাও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে কাথলিক খ্রীষ্টভক্তদের মধ্যে বাইবেল বিষয়ে জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। ব্যক্তিগতভাবে কারণস্বরূপ যে বিষয়গুলো আমি চিহ্নিত করতে পেরেছি:
১. বাংলা ভাষায় কাথলিক বাইবেল: কাথলিকদের জন্যে বাংলা ভাষায় অনুদিত প্রথম বাইবেল হচ্ছে প্রতিবেশী প্রকাশনী কর্তৃক ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘মঙ্গলবার্তা’। এই বাইবেলে মাত্র নব সন্ধি’র পুস্তকগুলো আছে। প্রাক্তন সন্ধি থেকে একটি পুস্তক সামসঙ্গীত এতে অন্তভূর্ক্ত করা হয়েছে। ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত সাধু বেনেডিক্টের মঠ কর্তৃক অনুদিত বাইবেল হলো ‘জুবিলী বাইবেল’। এই বাইবেলে প্রাক্তন সন্ধি এবং নব সন্ধি’র সকল পুস্তক সন্নিবেশ করা হয়েছে। তাই বিষয়টি স্পষ্ট যে, আশির দশকে’র পূর্বে বাংলা ভাষায় বাইবেলের কোন কাথলিক সংস্করণ এই দেশে ছিলনা। একবিংশ শতাব্দী’র পূর্বে এমনকি প্রাক্তন সন্ধি’র কাথলিক সংস্করণও ছিল না। আশির দশকের পূর্বে নব সন্ধি এবং ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে প্রাক্তন সন্ধি পাঠ করার অভ্যাস তাই স্বভাবতই কাথলিকদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে বাইবেল দুইটি সহজ প্রাপ্য হলেও, বহু দিনের অনভ্যাসকে আমরা আর অভ্যাসে পরিণত করতে পারিনি।
২. প্রটেস্ট্যান্ট অনুদিত বাইবেলে অনীহা: ডঃ উইলিয়াম কেরী, যিনি একজন বৃটিশ ব্যপ্টিস্ট মিশনারী ছিলেন; তিনি পবিত্র বাইবেলকে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ১৭৯৩ এবং ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে। এই বাইবেল আমাদের দেশে ‘লাল বাইবেল’ নামে সমধিক পরিচিত। লাল বাইবেল সহজলভ্য হলেও কাথলিক খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের অনেকে এই বাইবেল পাঠে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না। তাই প্রটেস্ট্যান্ট খ্রীষ্টভক্তগণ যখন বাংলা বাইবেল ব্যবহার করে এর সাথে পরিচিতি গড়ে তুলছে, কাথলিক খ্রীষ্টভক্তগণ তখন প্রটেস্ট্যান্ট অনুদিত বাইবেল পাঠে অনীহার কারণে সেই পরিচিতি লাভ করতে পিছিয়ে গিয়েছে।
৩. কাথলিক বাইবেলের প্রাপ্যতা: মঙ্গলবার্তা এবং জুবিলী বাইবেল দু’টি দুষ্প্রাপ্য না হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাইবেলের মত সেগুলো ততটা সহজ প্রাপ্যও নয়। আমাদের বাইবেল দু’টি প্রায় সময়ই out of print থাকে। আবার যখন মজুদ থাকে, সাধারণ খ্রীষ্টভক্তগণ যেন সহজে সংগ্রহ করতে পারে সেরূপ কোন ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।
৪. ভাষার জটিলতা: বিগত সময়ে ব্যাপকভাবে আদিবাসীগণ খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আদিবাসী ভাষা সমূহের বেশীরভাগেরই নিজস্ব লেখ্যরূপ নেই, বা থাকলেও সাধারণের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় নয়। বাংলা ভাষায় বাইবেল বাঙ্গালীদের মধ্যে বোধগম্য ও জনপ্রিয় হলেও অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর জন্য সেগুলো সহজে বোধগম্য নয়। আদিবাসী ভাষায় অনুদিত কোন কাথলিক বাইবেল নেই। প্রটেস্ট্যান্ট অনুবাদ থাকলেও, দেখা যায় যেহেতু তা ইংরেজী বা বাংলা হরফে লিখিত, সেগুলো পাঠ করা তাদের কাছে এমনকি বাংলা বাইবেল পাঠ করার চাইতেও কঠিন। ত্রিপুরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজনকে আমি এই কথা বলতে শুনেছি।
৫. ধর্মশিক্ষার কাঠামো ও মডিউল: কাথলিক মণ্ডলীর ধর্মশিক্ষা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম ভাগেই ঐশ প্রত্যাদেশ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে এবং পবিত্র শাস্ত্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা দান করা হয়েছে। আবার দ্বিতীয় ভাটিকান মহসভার ঐশ প্রত্যাদেশ বিষয়ক ধর্মতাত্ত্বিক সংবিধানের তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায়ে পবিত্র বাইবেল বিষয়ে বিস্তারিত শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু প্রয়োজনানুযায়ী ধর্মশিক্ষার কোন কাঠামো ও মডিউল গড়ে ওঠেনি। প্রার্থনা মুখস্তকরণ, বিভিন্ন আজ্ঞা মুখস্তকরণ এবং পবিত্র সাক্রামেন্ত সম্পর্কে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক শিক্ষা দেয়া হলেও পবিত্র বাইবেল বিষয়ে শিক্ষার ব্যাপারে ততটা গুরুত্বারোপ করা হচ্ছেনা।
বিভিন্ন বয়সের খ্রীষ্টভক্তদের (যেমন: শিশু, যুব ও বয়স্ক) কোন পর্যায়ে কি ধর্মশিক্ষা দেয়া হবে তেমন কোন মডিউল আমরা এখনো তৈরী করতে পারিনি। বেশীরভাগ কাথলিক মনে করে প্রথম কম্যুনিয়ন এবং হস্তার্পন সাক্রামেন্ত গ্রহণের ধর্মশিক্ষার পরে আর কোন ধর্মশিক্ষার প্রয়োজন নেই।
বিভিন্ন ধরণের যুব কর্মসূচীতে পবিত্র বাইবেল বিষয়ে শিক্ষা’র ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখি এসএসসি উত্তর কোর্সে যা শিক্ষা দেয়া হয়, সেই একই শিক্ষা এইচএসসি উত্তর কোর্সে এমনকি স্নাতকোত্তর কোর্সেও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
৬. বাইবেল বিষয়ে শিক্ষা: বিভিন্ন গঠন কর্মসূচীতে বাইবেল বিষয়ে যা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো তথ্যমূলক (যেমন: ঐশ প্রত্যাদেশ বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা, পুস্তক সমূহের নাম, পরিচিতি, ইত্যাদি)। কিন্তু বাইবেলের ঐশতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিষয়ে খ্রীষ্টভক্তদের শিক্ষা দানের তেমন একটা ব্যবস্থা চোখে পড়েনা। দু’একটি শহরের ধর্মপল্লীতে থাকলেও, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাইবেল স্টাডি গ্রুপ আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।
৭. ভক্তিমূলক প্রার্থনা: কাথলিক বিশ্বাসীগণ বাইবেল কেন্দ্রিক উপাসনা বা কর্মসূচীর চাইতে ভক্তিমূলক প্রার্থনা (যেমন: রোজারী প্রার্থনা, নভেনা) বেশী পছন্দ করে। খ্রীষ্টভক্তদের বিশ্বাস ও ভক্তি বাড়াতে ভক্তিমূলক প্রার্থনা খুবই গুরুত্ব পালন করে। তবে আমরা প্রায়ই মনে রাখি না যে, ভক্তিমূলক প্রার্থনা সমূহের উৎসও কিন্তু পবিত্র শাস্ত্র। ভক্তিমূলক প্রার্থনাকে পছন্দ করার মানে নয় আমাদের বাইবেল কেন্দ্রিক প্রার্থনা বা কর্মসূচীতে অনীহা থাকতে হবে।
কাথলিকগণ বাইবেল সম্পর্কে কি বিশ্বাস করে?
যদি খ্রীষ্টভক্তদের জিজ্ঞাসা করা হয়, বাইবেল কি? অধিকাংশই বলবে, খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কাথলিকগণ বাইবেল সম্পর্কে কি বিশ্বাস করে? অনেকে অনেক রকমের উত্তর দেবে। অনেকের কাছে হয়তো কোন উত্তরই পাওয়া যাবে না। অন্য সকল মণ্ডলীর খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের সাথে কাথলিকদের বাইবেল সম্পর্কে বিশ্বাসে পার্থক্য আছে। আসুন দেখি, বাইবেল সম্পর্কে আমরা কি বিশ্বাস করি।
বাইবেল কে লিখেছে?
কে বাইবেল লিখেছে- ঈশ্বর? নাকি মানুষ? কাথলিকদের ক্ষেত্রে দু’টো প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে ‘হ্যাঁ’! পবিত্র শাস্ত্র হচ্ছে ঈশ্বরের বাক্য, মানুষের ভাষায় লিখিত। ঈশ্বর হচ্ছেন বাইবেলের মূল লেখক। তাই আমরা বিশ্বাস করি, পবিত্র শাস্ত্রে যা কিছু বলা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য। বিষয়টি বুঝতে পারলে, বাইবেল কখনোই আমাদের বিপথগামী করবে না।
প্রাক্তন এবং নব সন্ধি
প্রাক্তন এবং নব সন্ধি- দুইটি মূল অংশে বাইবেল বিভক্ত। যীশুর জন্মের আগে প্রাক্তন সন্ধি রচিত হয়েছে এবং নব সন্ধি রচিত হয়েছে মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পরে। প্রাক্তন সন্ধিতে বিভিন্ন ধরণের পুস্তক আছে, যেমন: ঐতিহাসিক, জ্ঞানধর্মী এবং প্রাবক্তিক গ্রন্থ। প্রাক্তন সন্ধিতে ঈশ্বর ও মানুষ সম্পর্কে প্রজ্ঞা এবং জ্ঞানের কথা লিখিত হয়েছে। যীশুখ্রীষ্ট সম্পর্কে প্রাক্তন সন্ধি আমাদের পূর্বাভাস দেয়। যদিও প্রাক্তন সন্ধি যীশুর জন্মের আগে লেখা হয়েছে, তথাপি এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কাথলিকগণ একে অবহেলা করেনা।
মঙ্গলসমাচার (চারটি পুস্তক যা যীশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ঘটনা নিয়ে লিখিত) নব সন্ধি’র হৃদয়। নব সন্ধি’র অন্যান্য পুস্তকগুলোর অধিকাংশই সাধু পল বা অন্য প্রেরিত শিষ্যদের লেখা ধর্মপত্র।
প্রাক্তন ও নব সন্ধি অঙ্গাঙ্গীকভাবে সম্পর্কিত। কাথলিকরা প্রাক্তন সন্ধি’র আলোকেই নব সন্ধি পাঠ করে এবং দেখে কিভাবে প্রাক্তন সন্ধিতে নব সন্ধি’র পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। প্রাক্তন সন্ধিতে দেয়া পূর্বাভাসগুলো যদিও নব সন্ধিতে পূর্ণ হয় বা বাস্তবে ঘটে, তথাপি প্রাক্তন সন্ধি’র কোন ঘটনাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং নব সন্ধির মতই প্রাক্তন সন্ধি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা আমাদের প্রতি পরমেশ্বরের ভালবাসার ইতিহাসকে প্রকাশ করে। যীশু যখন এসেছিলেন সবাই কিন্তু তাকে গ্রহণ করেনি। তারাই গ্রহণ করেছে, যারা প্রাক্তন সন্ধিতে দেয়া যীশু’র আগমনের পূর্বাভাস এবং প্রতিশ্রুতি বুঝতে পেরেছে। তাই কাথলিক হিসেবে যীশুখ্রীষ্টকে চিনতে হলে প্রাক্তন সন্ধির আলোকেই আমাদের নব সন্ধি পাঠ করতে হবে। সাধু আগস্টিনের মত বলা যায়, ‘প্রাক্তন সন্ধিতে নব সন্ধি লুক্কায়িত, নব সন্ধিতে প্রাক্তন সন্ধি প্রকাশিত’।
বাইবেল অনুপ্রাণিত
ঈশ্বর মানুষকে বাইবেল লিখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। মানব রচয়িতাগণ নিজের ক্ষমতা এবং জগত সম্পর্কে তখনকার সময়ে তাদের ধ্যান-ধারণা’র আলোকে পবিত্র বাইবেলের পুস্তকগুলো লিখেছেন। যেমন সাধু লুক বলেছেন, তিনি মঙ্গলসমাচারে যা উল্লেখ করেছেন, সে সমস্ত ব্যাপারে গবেষণা করেছেন। লুক ছিলেন একজন দক্ষ গল্পকার, খুব সুন্দর একটা গল্পের মত করে তিনি যীশুর জীবনি লিখেছেন। ঈশ্বর সাধু লুককে প্রতিটি শব্দ বলে বলে লেখাননি। নিজের মেধা ও ধরণে মঙ্গলসমাচার লিখতে ঈশ্বর লুককে স্বাধীনতা দিয়েছেন।
সাধু লুক লিখিত মঙ্গলসমাচারের প্রকৃত রচয়িতা হচ্ছেন সাধু লুক, কিন্তু যেহেতু তিনি ঈশ্বর দ্বারা অনুপ্রাণিত, ঈশ্বর হচ্ছেন এর মূল রচয়িতা। আমরা যখন বলি বাইবেল অনুপ্রাণিত, এর অর্থ হচ্ছে পবিত্র বাইবেলের বাক্যে ঈশ্বর অনন্যরূপে কাজ করেছেন। পবিত্র বাইবেলের মানব রচয়িতাগণ তাই লিখেছেন, যা ঈশ্বর চেয়েছেন- অতিরিক্ত বা কম কিছুই তারা লেখেননি।
বাইবেলের ব্যাখ্যা
কাথলিক বিশ্বাস হচ্ছে বাইবেলে যা সত্য রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষেই সত্য। কিন্তু এই সত্যের অর্থ কি? এর মানে কি এই যে ঈশ্বর সত্যিই চব্বিশ ঘন্টার সাত দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন? আবার এই কথাও কি সত্যি যে যীশু চান যে অঙ্গ আমাদের পপের পথে নিয়ে যায় তা আমরা কেটে ফেলি? না! বাইবেলে যা বলা হয়েছে তার সবকিছু আক্ষরিক সত্য নয়। আদিপুস্তকের রচয়িতা যে সত্য আমাদের কাছে বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে ঈশ্বর ভালবেসে পরিকল্পনা মাফিক মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। যীশু যখন বলেন, যে অঙ্গ পাপের পথে আমাদের নিয়ে যায় তা কেটে ফেল (দ্র: মথি ৫: ৩০); তিনি আসলে রূপক ব্যবহার করে পাপে পতিত হওয়ার কার্যকারণগুলো এড়িয়ে চলতে আমাদের শিক্ষা দেন।
বাইবেলের ব্যাখ্যা বোঝার জন্য নির্দিষ্ট পুস্তক লেখার সময়ে ঐ পুস্তকের রচয়িতার উদ্দেশ্য কি ছিল তা অনুধাবন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাজাবলী ১ম পুস্তকটি ঐতিহাসিক, পরম গীত পুস্তকটি কাব্যিক, প্রত্যাদেশ পুস্তকটি গভীরভাবে রূপক নির্ভর। রাজাবলী- ১ পাঠে তাই আমরা দেখি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরম গীত পুস্তকে কবির ভাষায় ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা ও বন্দনা, প্রত্যাদেশ গ্রন্থে প্রবক্তা’র দর্শনে রূপক শিক্ষা একেকটি পুস্তক পাঠে একেক রকমের দৃষ্টিভঙ্গি কাথলিক হিসেবে আমরা ব্যবহার করি।
কাথলিক মণ্ডলী এবং বাইবেল
বাইবেল ঈশ্বর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লিখিত, তাই কাথলিকদের বাইবেলের ব্যাখ্যা বুঝতে হবে পবিত্রাত্মার আলোকে। প্রকৃতপক্ষে বাইবেলের প্রতিটি পুস্তকের রচয়িতা একজন- স্বয়ং ঈশ্বর, তাই কাথলিকগণ বিশ্বাস করে বাইবেল কখনোই স্ববিরোধী নয়। অনন্য উপায়ে পবিত্র আত্মা মণ্ডলীকে পরিচালনা দান করে। পবিত্র বাইবেলে কোন পুস্তকগুলো অন্তভূর্ক্ত হবে তা নির্ধারণ করতে যে পবিত্র আত্মা মণ্ডলীকে নির্দেশনা দিয়েছে, সেই একই পবিত্র আত্মা বাইবেলের ব্যাখ্যা দানে মণ্ডলীকে পরিচালনা করে। তাই কাথলিক বিশ্বাসীগণ নিজের বোঝাপড়ায় বাইবেলকে ব্যাখ্যা করেনা, বরং পবিত্র শাস্ত্রে ঈশ্বর কি বলছেন তা বোঝার জন্য মণ্ডলীর কর্তৃপক্ষের প্রজ্ঞা’র উপরে নির্ভর করে।
প্রত্যেক কাথলিকের বাইবেল জানা উচিত
যদিও মণ্ডলী পবিত্র বাইবেলের প্রধান ব্যাখ্যাদানকারী, তথাপি প্রত্যেক কাথলিক বিশ্বাসীরই উচিত বাইবেলকে নিজ জীবনের একটি অংশরূপে গ্রহণ করা। এই কথা তাদের জন্যেও প্রযোজ্য যারা কম বয়স বা শিক্ষিত নয় বলে পড়তে পারে না। প্রত্যেক খ্রীষ্টযাগে মণ্ডলীর যত্নের সাথে পবিত্র শাস্ত্রকে প্রচার করে। মণ্ডলী মনে করে খ্রীষ্টভক্তদের নিয়মিত বাইবেল পাঠ করা উচিত, কারণ “শাস্ত্র সম্পর্কে মূর্খতা হচ্ছে, খ্রীষ্ট সম্পর্কে মূর্খতা” (সাধু জেরম)।
বাইবেল হচ্ছে মানুষের কাছে ঈশ্বরের প্রেম-পত্র। আমাকে লেখা ঈশ্বরের প্রেম-পত্র, আপনাকে লেখা ঈশ্বরের প্রেম-পত্র! ঈশ্বর আমাদের হাতে বাইবেল দিয়েছেন বলে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। বাইবেল যে শুধুমাত্র ঈশ্বরকে জানতে আমাদের সাহায্য করে তাই না, বরং ঈশ্বরের সাথে গভীরতর সম্পর্ক তৈরীতে আমাদের অনুপ্রাণিত করে।