Skip to content
Home » আবরার ফাহাদের মৃত্যু এবং বিবিধ মৃত্যু

আবরার ফাহাদের মৃত্যু এবং বিবিধ মৃত্যু

আবরার ফাহাদের মৃত্যু! চিরাচরিত অপঘাতে মৃত্যু মিছিলে যোগ হওয়া আরেকটি নাম! বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডগোলের বলি, নিত্যনৈমিত্তিক আরেকটি দুর্ঘটনা!…. রাষ্ট্রযন্ত্র আর আমাদের মত অনুভূতিশূণ্য নাগরিকের কাছে এই হলো আবরার ফাহাদের মৃত্যুর চূড়ান্ত উপসংহার।
কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডের বাড়ীটিতে কিন্তু মৃত্যু হয়েছে এক মায়ের আদরের খোকার, শুণ্য কোলে যে মায়ের কন্ঠে এখন শুধুই আহাজারি! এক ছোট ভাই আবরার ফায়াজের প্রিয় ভাইয়ের, ভরসা হারিয়ে যার চোখে এখন শুধুই অভিব্যক্তিহীনতা! এক পিতার বুকের ধন সন্তানের, ডুকড়ে কেঁদে উঠে যার পিতৃত্ব এখন অক্ষমতাকে অভিশাপ দেয়! 
দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বহু ছাত্র-ছাত্রীর জন্য যা অধরা স্বপ্ন। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতায় অধরা সেই স্বপ্নের নাগাল পাওয়া মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ ছিল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলী, কে জানে, হয়তো বিজ্ঞানীও। আবরার ফাহাদের হত্যার সাথে যারা জড়িত, তারাও সকলে ভবিষ্যত প্রকৌশলী! বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, তদুপরি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, যারা মেধায় এগিয়ে আছে অন্যদের চাইতে; তাদেরই কেউ পিটিয়ে মারলো আরেক মেধাবী সহপাঠিকে! কুকুর পিটিয়ে মারাতো দূরে থাক, কুকুরকে যেন আঘাতও করা না হয়, সেজন্যে দেশে আন্দোলন হচ্ছে, আইন প্রণীত হয়েছে। সেই একই দেশে সাধারণের চাইতে উপরে থাকা মেধাবী ছাত্ররা পিটিয়ে মেরে লাশ ফেলে দিল আরেক মেধাবী ছাত্রের! বিবেক আর মনুষ্যত্বের কি নিদারুণ পরিণতি! আবরারকে একা হত্যা করা হয়নি, বিবেক আর মনুষ্যত্বকেও পিটিয়ে মেরা ফেলা হয়েছে এ’দেশে।
কি প্রচণ্ড মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত এ’জাতি, যে জাতির সন্তানেরা ভিন্নমতের কাউকে পিটিয়ে মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়! অবিকল একাত্তরের পুনরাবৃত্তি, বাঙালীকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে রাস্তায়, নর্দমায়, খালে, বিলে। পরিবর্তন ঘটেছে শুধু চরিত্রে- তখন ভিলেন ভূমিকায় ছিল পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা (স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি) আর এখন আছে ছাত্রলীগের সোনার সন্তানেরা (স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি)। এই অসুস্থতার জন্ম কোথায়?
দেশ আজ সুস্পষ্টভাবে দু’টি মেরুতে বিভক্ত! স্বাধীনতার স্বপক্ষ আর বিপক্ষ! শুরুতে এটি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবীতে জাতীয় চেতনার উন্মেষ। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ঘিরে থাকা চাটুকার নব্য আওয়ামীলিগারদের আখের গোছানোর তুরুপের তাশে। যখনই ভিন্নমতের উদ্ভব ঘটে, সেই মতধারী হয়ে যায় স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি! বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ চাটুকার নব্য আওয়ামীলিগারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত! ছাত্র সংগঠন মূল রাজনৈতিক দলের আদর্শ বহন করবে তা খুবই স্বাভাবিক। আদর্শ আর দল পাল্টানো নব্য আওয়ামীলিগাররা এতটাই অসুস্থ যে, দেশ বিক্রি করে সম্পদের পাহাড় গড়ার মানসে, ক্ষমতার মসনদ চিরস্থায়ী করার প্রচণ্ড আকাঙ্খায় ঠাণ্ডা মাথায় প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ খুন করে একের পরে এক; ঠিক যেন একেকজন সিরিয়াল কিলার! তাদের উপযুক্ত শিষ্য হিসেবে ছাত্রলীগের মধ্যে একই অসুস্থতা সংক্রমিত হয়েছে, বেশ গভীরভাবেই হয়েছে। এই দানবেরা কিন্তু পঁচাত্তরেও ছিল। তারা বঙ্গবন্ধু আর তার পুরো পরিবারের বুক চিরে রক্ত পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছিল সে যাত্রা। বিদেশ থাকায় বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাকে ঘিরে একই চাটুকার দানবেরা আবার বলয় তৈরী করছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সাবধান, চাটুকারদের এখনই যা দম্ভ; আপনার শাসনের বেড়া ডিঙ্গোতে তাদের বেশী সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছেনা।
দেশের সর্বস্তরে পা-চাটাদের বিচরণ। যে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্বশাসিত, তার প্রশাসন ও শিক্ষকেরাও স্বাধীনতার স্বপক্ষ আর বিপক্ষের মেরুকরণ করে গুছিয়ে নিচ্ছে আখের। ফরেনসিক রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে অন্ততঃ এক ঘন্টা আবরারকে হকিস্টিক, লাঠি বা ডাণ্ডা দিয়ে পেটানো হয়েছে। সাথে সাথে হাসপাতালে নেয়া গেলে তাকে বাঁচানো যেতো। আবরারের অপরাধ ছিল সে ভারতের সাথে ফেনী নদীর পানি বন্টন নিয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। হায়, যে খবরে আবরারের এই স্ট্যাটাস, বিবিসি পরিবেশিত সে খবরও না কি ভুল খবর! তাই তার কপালে পড়ে যায় স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি- ‘শিবির’ তকমা! ছাত্রলীগের ছেলেরা যেহেতু স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি, তাই তারা পুলিশ হয়ে আবরারকে ডেকে পাঠায়, গোয়েন্দা হয়ে তার মোবাইল ও মেসেঞ্জারে শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ খোঁজে, বিচারক হয়ে তার মৃত্যুদণ্ড বিধান করে, জল্লাদ হয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ক্ষমতা ও সম্পদের বলয়ে ঢুকতে হলে যেভাবেই হোক, ভিন্নমত দমন করতে হবে, বড় নেতাদের আস্থাভাজন হতে হবে- ছাত্রদের মস্তিষ্কে চরমভাবে এই মনোভাব প্রবিষ্ট হয়ে আছে। ভাবতে অবাক লাগে, এই অমানুষগুলোর বয়স মাত্র বিশ পেরিয়েছে, এরই মধ্যে তারা হাদের নিজ মনুষ্যত্বকে খুন করে ফেলেছে!
শের-ই-বাংলা হল প্রভোস্ট খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসেছেন আবরারের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরে। কারণ হত্যায় বাধা দিলে সেটা হতো তার পক্ষে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তিকে বাধা দেয়া, তিনি চিহ্নিত হবেন বিপক্ষ শক্তি হিসেবে। তা তিনি হতে চাইবেনই বা কেন? এই সব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্যতার চাইতে রাজনৈতিক পরিচয়টাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া শিক্ষক এখন ছাত্রদের শাসন করেন না, বরং ছাত্রদের ভয়েই শিক্ষক তটস্থ থাকেন। চাটুকারদের ভয়াবহ ছায়া বিদ্যাপীঠেও! দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপিঠের ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ভার বিদ্যালয় প্রশাসনের। নিজের হলের একজন ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলার পরেও প্রভোস্ট স্বীকার করেননি কোন দায়ভার, করবেনও না কোনদিন। সেই বোধ ও বিবেকের জন্ম আমাদের প্রশাসনে আজ পর্যন্ত হয়নি। এই প্রভোস্টের নৈতিক মৃত্যু তো বহু আগেই হয়ে আছে।
শের-ই-বাংলা হলের ২০১১ নং কক্ষে নাকি আবরারকে পেটানো হয়েছে। হলটি দেখিনি, তাই জানিও না এই কক্ষের আশেপাশে আর কোন কক্ষ আছে কি না। যদি থাকে, সেই কক্ষগুলোতে কি সাধারণ ছাত্ররা ছিল না? তারা কি এতরাতে একটি যুবক ছেলের চিৎকার শুনতে পায়নি? কেউই কি একটি লাশ টেনে নিয়ে সিড়ির নীচে ফেলতে দেখেনি? ছাত্ররা ছিল, চিৎকারও শুনতে পেয়েছে, দেখেছেও। কিন্তু কেউই প্রতিবাদী হতে গিয়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির বিরাগভাজন হতে চায়নি, তাতে বেঘোরে জান হারাতে হতে পারে; সেটাই তারা অভিজ্ঞতা করেছে যুগের পর যুগ। তাই দরজায় খিল দিয়ে চুপ করে বসে থাকাকেই তারা অধিকতর নিরাপদ মনে করেছে। ঠিক যেমন একাত্তরে পাকহানাদার বাহিনীর ভয়ে মানুষজন দরজা এটে বসে থাকতো। এই সাধারণ ছাত্রগুলোর কারো রক্তে কোন উদ্দামতা নেই, বরফ শীতল স্পন্দনহীন মরা নদী হয়ে গিয়েছে শরীরের সব শিরা উপ-শিরা। ‘খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো; বর্গী এলো দেশে’; খোকারা ঘুমিয়ে থাকায় দেশ মা আজ বর্গীর থাবায় ক্ষত-বিক্ষত।
বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শোভন-রাব্বানীকে অপসারণ করার সময়ে বলেছেন তারা দানব হয়ে গিয়েছে। ছাত্রলীগ, অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠন ও আওয়ামীলীগে দানবের কোন অভাব নেই। আবরারের মৃত্যুতে আরেকটি চাক্ষুস প্রমাণ পেলেন। দেরী করবেন না, এখনই ছাত্রলীগকে আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করুন, নয়তো তাদের আগুন আপনার দিকেই ধেয়ে আসবে। সংশ্লিষ্টদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে, আমরা আশাবাদী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি এই হত্যার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে আশাহীন আমাদের আশা ফিরিয়ে আনুন। রাজনৈতিক কারণে ছাত্রলীগের সাথে আরেকটি বৈঠকে বসার আগেই আপনি আবরারের সুবিচার নিশ্চিত করুন, যেন ওর রক্ত আপনার কানের কাছে হাহাকার না করে, ওর মায়ের কান্না আপনার মস্তিষ্কে চিরস্থায়ী জায়গা করে না নেয়। দলে দুর্ণীতি বিরোধী যে শুদ্ধি অভিযান আপনি শুরু করেছেন, তাকে সাধুবাদ জানিয়ে একই অভিযান দলের সকল মানুষ খুন করা দানবদের বিরুদ্ধে শুরু করতে সাধারণ জনতার একজন হিসেবে আপনাকে অনুরোধ জানাই। বঙ্গবন্ধুর প্রেম, এই বাংলার আর একটা ছাত্র, আর একটা মানুষ যেন অপঘাতে মারা না যায়, এই নিশ্চয়তা দেয়ার সক্ষমতা আপনার ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী দলের প্রবীণ নেতাদের আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

Leave a Reply