Skip to content
Home » ঐশবাণীর আলোকে পরিবার গঠন

ঐশবাণীর আলোকে পরিবার গঠন

নাজারেথের পুণ্য পরিবার হলো সকল খ্রিস্টিয় পরিবারের আদর্শ। পুণ্য পরিবার ছিল ধর্মময়, প্রার্থনাশীল ও নানাবিধ গুণাবলীতে সমৃদ্ধ। তাই ঐশবাণী’র আলোকে পরিবার গঠনের অভিপ্রায়ে নাজারেথের পুণ্য পরিবারের গুণাবলীসমূহ প্রথমেই আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা নেয়া উচিত। নবসন্ধিতে বর্ণিত পুণ্য পরিবারকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা এমন কিছু সন্দেহাতীত মূল্যবোধ ও গুণাবলীর সাথে পরিচিত হবো, আজকের বিভাজিত পৃথিবীর প্রতিটি পরিবারে যা প্রচণ্ডভাবে প্রয়োজন।
 
পুণ্য পরিবারের গুণাবলীসমূহ: 
প্রথমতঃ ঈশ্বর স্বয়ং পুণ্য পরিবারের সদস্যদের একত্রিত করেছেন। তিনিই বিবাহে মারীয়া ও যোসেফকে একত্রিত করেছেন। পবিত্র আত্মা শিশু যীশুকে তাদের পরিবারের ছায়ায় এনেছেন। পুণ্য পরিবার ছিল ঈশ্বরের সৃষ্ট।
দ্বিতীয়তঃ পুণ্য পরিবারে অবশ্যই বৈচিত্র্য ছিল। যীশু, মারীয়া এবং যোসেফ সকল হিসাবেই ছিল ভিন্ন মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাদের স্বভাব ও আচরণগত ভিন্নতা বোঝা কঠিন নয়।
তৃতীয়তঃ ব্যক্তিগত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও পুণ্য পরিবারে ছিল পারিবারিক একতা। তারা শুধু একসাথে বসবাসই করেনি, তারা একসাথে প্রার্থনা করেছে, একসাথে কাজ করেছে এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা একসাথে পরিবার হিসেবে বসবাস করেছে।
চতুর্থতঃ তাদের যে একতার বন্ধন ছিল, তার অর্থ এই নয় যে তারা সকলেই ছিল সমান। কারণ তারা সমান ছিলনা। বরং একতার বন্ধনের মূলে ছিল ভালবাসা, প্রকৃত ভালবাসা।
পঞ্চমতঃ পুণ্য পরিবারে বিদ্যমান ভালবাসার মূলে ছিল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সকলের অভিন্ন চিন্তা। তাদের মাত্র একটিই লক্ষ্য ছিল- মানবজাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে সকলে মিলে একটি ক্ষুদ্র সমাজরূপে কাজ করা।
নিজ পরিবারে পুণ্য পরিবারের গুণাবলীসমূহ অনুশীলণ:
আমরা এখন উপরোক্ত পাঁচটি গুণাবলীর প্রতিটি নিয়ে আলোকপাত করবো ও আমাদের জীবনে কিভাবে সেগুলো অনুশীলণ করা যায় তা দেখবো। প্রতিটি গুণাবলী থেকেই আমাদের শিক্ষা নেয়ার অনেক বিষয় আছে। পোপ দ্বিতীয় জন পল, পোপ বেনেডিক্ট, পোপ ফ্রান্সিস ক্রমাগত বলে চলেছেন, হয় আমরা যীশু, মারীয়া ও যোসেফ’র পুণ্য পরিবারের পারিবারিক মূল্যবোধসমূহ আবিষ্কার করবো অন্যথায় আমরা খ্রিস্টিয় সমাজ হিসেবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবিত হবো।
প্রথমতঃ নাজারেথের পুণ্য পরিবারের এই গুণাবলীটি সকল পরিবারের জন্য প্রযোজ্য: সকল পরিবারের জন্ম কিন্তু পরমেশ্বর থেকেই। কোন খ্রিস্টিয় দল- হোকনা না তা সামাজিক, পারিবারিক অথবা ধর্মপল্লীর এবং বৃহৎ পর্যায়ে মাণ্ডলীক কেউই একত্রিত হতে পারেনা যদি না ঈশ্বর তা চান।
প্রতিটি পরিবার অস্তিত্ব পেয়েছে জগতে পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মার সমন্বয়ে গঠিত ত্রিত্ত্বিয় অনন্ত পরিবারের সাক্ষ্য হতে। এই পরিবার হলো তিন ব্যক্তির পুণ্য ও অনন্ত পরিবার। ঈশ্বর একাকী ঈশ্বর নয়, তিনি মিলনের ঈশ্বর।
জগতের পরিবার হলো পবিত্র ত্রিত্ত্ব ঈশ্বরের পরিবারের মূর্ত প্রকাশ। পৃথিবীর পরিবারগুলোর সৃষ্টি বা গঠন ঈশ্বর বিহীন কোন সাধারণ ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়। কোন না কোনভাবে আমাদের বাবা-মায়ের দেখা হলো, তারা বিবাহ সাক্রামেন্ত গ্রহণ করলেন আর আমাদের জন্ম হলো, বিষয়গুলো এতটা কাকতালীয় নয়। এ’ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ত্রিত্ত্বিয় পরিবার- ঈশ্বরই প্রতিটি পরিবার নিজে সৃষ্টি করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ পরিবারের সকল সদস্যই আলাদা। চলুন, এই ভিন্নতার গভীরে একটু আলোচনা করি। এই ভিন্নতার কারণ হলো প্রতিটি সন্তানের জন্য ঈশ্বরের নিজস্ব পরিকল্পনা। যখনই তিনি আমাদের সকলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আত্মা সৃষ্টি করেন, তখনই তিনি আমাদের মধ্যে এই ভিন্নতাগুলো রচনা করেন। তাই মাতৃগর্ভে ভ্রূণ রচনার সময় থেকেই প্রতিটি আত্মা স্বতন্ত্রভাবে, ভিন্নভাবে এবং তুলনাহীনভাবে ঈশ্বর সৃষ্টি করেন।
সৃষ্টিতে বিচিত্রতা নিখুঁত পরমেশ্বরের অনন্ত মহিমার প্রতিফলণ। এমনকি দশ লক্ষ্য তুষাড় কণা’র মধ্যে দু’টিও পরস্পর হতে আলাদা! ঈশ্বর চান আমরা যেন আলাদা হই। সেভাবেই তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন।
তৃতীয়তঃ পরিবারের সদস্যবৃন্দ ভিন্ন হলেও তারা একতার মিলনে আবদ্ধ হতে আহুত। যেভাবে ঈশ্বরের তিন ব্যক্তি এক নন। পিতা কিন্তু পুত্র নয়। আবার পিতা ও পুত্র কিন্তু পবিত্র আত্মা নয়। তবু তিন ব্যক্তির মিলনে এক ঈশ্বর! তাই প্রতি পরিবারের সকল সদস্যকে হতে হয় একতার মিলনে সম্মিলিত। পরিবারের একজন সদস্য যদি বিরক্তিকর এবং লজ্জাজনকভাবেও আলাদা হয়, তথাপি পরিবার পরিবারই থাকে। পরিবারের কোন সদস্য যদি শুধুই নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে, অপরের জন্য না ভাবে, তবুও পরিবার পরিবারই। পরিবার হচ্ছে পরিবার। এটি কোন সংঘ, সমিতি, দল বা হঠাৎ সাক্ষাৎ হওয়া কোন মানুষের সম্মিলনী নয়।
চতুর্থতঃ ভালবাসা হচ্ছে পরিবারকে একতায় রাখার বন্ধন। ভালবাসাই একমাত্র শক্তি যা আলাদা, এমনকি অসম ব্যক্তিদেরও এক করতে পারে। শুধু ভালবাসাই পারে তাদেরকে একসাথে আনতে, একসাথে রাখতে এবং একসাথে কাজ করতে একটি পরিবার হয়ে। যখন এই ভালবাসা অনুপস্থিত বা দূর্বল, তখন পরিবারটি আর পরিবার হিসেবে টিকে থাকেনা। এটি ইতিহাসের শিক্ষা।
ভালবাসার প্রকাশ জীবনকর্মে। ভালবাসার অর্থ হচ্ছে স্বার্থহীন ভালবাসা, পরিবারের ভাল’র জন্য নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ- অপছন্দগুলো জলাঞ্জলী দেয়া।
পঞ্চমতঃ সম্মিলিত ভালবাসার ভিত্তি হচ্ছে সম্মিলিত লক্ষ্য। যদি শুধুমাত্র ভালবাসাই ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে একত্রিত করতে পারে, তাদেরকে একসাথে থাকতে ও কাজ করতে সক্ষমতা দিতে পারে, তাহলে একটি পরিবারের সমন্বিত লক্ষ্যই তাদেরকে পরিবার হিসেবে অস্তিত্ব দিতে এবং পারিবারিক জীবন টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে।
আমাদের কাথলিকদের জন্য, এই সমন্বিত লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বাসে জন্মলাভ করা, যদি আমরা এক ঈশ্বর, এক কাথলিক মণ্ডলী, পৃথিবীতে খ্রিস্টের এক প্রতিনিধি, মানবজাতির এক গন্তব্য, পরিত্রাণের এক উপায় বিশ্বাস করি। আর এই বিশ্বাসই পারে আমাদের এক রাখতে। সমন্বিত লক্ষ্যের কোন বিকল্প নেই। পুন্য পরিবারের মত আমাদের সমন্বিত লক্ষ্য হতে হবে মানব পরিবারের পরিত্রাণ। পরিবারের সদস্যদের ভিন্নতা সত্ত্বেও ভালবাসার বন্ধনে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ সম্ভব।
পরিবারে ঐশবাণী পাঠের অভ্যাস:
ঐশবাণী’র আলোকে পরিবার গঠনের অভিপ্রায়ে পরিবারে ঐশবাণী নিয়মিত পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। শুধু বাবা পাঠ করবে তা নয়, আবার শুধু মা-ও নয়। পরিবারের সকলকে নিয়ে ঐশবাণী পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।
পরিবারের সবাই মিলে একসাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাইরে খেতে যাওয়া, একসাথে সিনেমা দেখা- এই বিষয়গুলো সব পরিবারই উপভোগ করে, কারণ সবাই মিলে তা করছে। ঠিক একইভাবে পরিবারের সকলে মিলে ঐশবাণী পাঠে তা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। এই অভ্যাস গড়ে তোলা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
ঐশবাণী পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে নিম্নের পরামর্শগুলো উপযুক্ত হতে পারে।
প্রত্যাশা নির্ধারণ: ঐশবাণী পাঠের আগে আমাদের প্রত্যাশা ঠিক করে নিতে হবে। যেমন: পরিবারের সকল সদস্য যেন একে অন্যকে মর্যাদা ও সৌজন্য প্রদর্শন করে, মনযোগী হয়। মনযোগী হওয়া ও পরিবারের কর্তৃত্বকে সম্মান করা হচ্ছে শৃঙ্খলা, শিশুদের যা শেখা উচিত। একে অন্যকে ভালবাসলে ঐশবাণী পাঠের সময়ে একে অন্যের সাড়াদান এবং শৃঙ্খলা অনুশীলণকে সম্মান দেয়া সম্ভব যাতে করে সবাই ঐশবাণী হতে সহভাগিতা করে ও তা থেকে রত্ন আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়।
বাইবেল হতে পাঠ করা: কিছু পরিবার ঐশবাণী পাঠের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরণের ভক্তিমূলক প্রার্থনা করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে কারণ এর প্রতি প্রত্যেকে উৎসাহী হয় ও সকলেই ব্যস্ত থাকে। অবশ্যই ভক্তিমূলক প্রার্থনা করা জরুরী, কিন্তু বাইবেল হতে সরাসরি ঐশবাণী পাঠ করা আরো গুরুত্বপূর্ণ। শুরুর দিকে, বিশেষভাবে যদি পরিবারে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে থাকে, তাহলে একটিমাত্র পুস্তক দিয়ে শুরু করা উচিত এবং প্রতিদিন মাত্র অল্প কয়েকটি পদ পাঠ করা উচিত। যেহেতু ছোট ছেলে-মেয়েরা পুনরাবৃত্তি পছন্দ করে, তাই একই পদগুলো দিনের বিভিন্ন সময়ে পুনরাবৃত্তি করা যায়, যেমন: সকালে, স্কুলের পরে, দুপুর ও রাতের খাবারের সময়ে এবং ঘুমানোর আগে। যদি খুবই অল্প কয়েকটি পদ নেয়া যায়, তাহলে আপনার পরপর ছেলে-মেয়েরা আবার বলতে পারে।
ছেলে-মেয়েদের খেলতে দেয়া: প্রার্থনার সময়ে ছেলে-মেয়েরা খেললে অনেক বাবা-মাই বিরক্ত হন। দৈনিক ঐশবাণী পাঠের সময়ে ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলতে দেয়া উচিত। তাদের জন্য এমন খেলনা বেছে নিতে হয়, যেগুলো দিয়ে তারা নীরবে খেলতে পারে। আবার বাইবেলের গল্প ভিত্তিক ছবি’র বইও দেয়া যায়, যেন তারা বসে বসে ছবিগুলো দেখতে পারে। তবে দীর্ঘ পাঠ হলেও ছোটদের একেবারে ভুলে গেলে চলবে না। অন্যদের পাঠ হয়ে গেলে, সেখান থেকে ছোট একটি বা দু’টি পদ বেছে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের দিয়ে তা মুখে মুখে বলানো যায়, বা অপেক্ষাকৃত বড় ছেলে-মেয়ে থাকলে পরিবারের অন্যদের জন্য অভিনয় করে দেখাতে পারে।
প্রশ্ন করা ও ছেলে-মেয়েদের প্রশ্ন করতে দেয়া: একে অপরের সাথে এবং ঐশবাণীর সাথে যোগাযোগের পথ হচ্ছে প্রশ্ন। বড় ছেলে-মেয়েদের জন্য বাইবেল পাঠের পরে কিছু প্রশ্ন করতে পারেন এবং তাদের উত্তরগুলো মনযোগ দিয়ে শুনতে পারেন। আপনার ছেলে-মেয়েদেরও মধ্যেও প্রশ্ন করার জায়গাটা তৈরী করুন। মাঝে মাঝে তারা প্রশ্ন করবে, মাঝে মাঝে করবে না, কিন্তু তারা জানবে, চাইলে তারা প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। এবং যখন তারা প্রশ্ন করে, যত সাধারণ প্রশ্নই হোক, চিন্তুা করে উত্তর দেয়া উচিত এবং এ’সময়ে উপদেশ না দেয়াই বাঞ্ছনীয়। যদি আপনি ছোট উত্তর দেন, তাহলে তারা আরো প্রশ্ন করতে উৎসাহ পাবে। যদি প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকে, সকলে মিলে আলাপ করা যায় এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে সাহায্য চাওয়া যায়।
শিক্ষার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করা: সবসময়ই আপনারা বাইবেল পাঠ করবেন আর ছেলে-মেয়েরা শুনবে, এমনটা নাও হতে পারে। ঐশবাণীতে বিভিন্নজনের উক্তি থাকে। যখন আপনার নির্ধারিত পাঠে তেমন কোন উক্তি থাকে, সেই উক্তিগুলো ছেলে-মেয়েদের দিয়ে নাটকীয়ভাবে পাঠ করাতে পারেন। অথবা বাইবেল থেকে একের পরে একজন একেকটি পদ বা কয়েকটি শব্দ এমনকি একটি শব্দও পাঠ করতে পারে।
এই পদ্ধতিগুলো অনুসরণে যখন পরিবারে ঐশবাণী পাঠের একটি অভ্যাস গড়ে ওঠে, তখন ধীরে ধীরে পরিবারের সকলে মিলে বাইবেল স্টাডি শুরু করতে পারে।
ঐশবাণীর আলোকে বাবা ও মা হিসেবে দায়িত্ব পালন:
সন্তানেরা ছোট বয়স থেকেই দেখে তার বাবা-মা কি বলে, কি করে, কি তাদের আচরণ। ধীরে ধীরে তারাও একইভাবে বলতে চায়, একই কাজ করতে চায়, একই আচরণ গঠিত হয়। এভাবে বংশ পরম্পরায় পরিবারের অভ্যাস ও আচরণ চলমান থাকে। এই বয়সে সন্তান যদি তার বাবা ও মায়ের মধ্যে উপযুক্ত আচরণ দেখতে পায়, তাহলে সেভাবেই তারাও বেড়ে ওঠে তাদের সন্তানদের সাথে আচরণ করে। তাই উপরোক্ত বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার অবকাশ নিচ্ছি।
বাবার দায়িত্ব সম্পর্কে ঐশবাণী কি বলে?
১. সন্তানের ‘প্রথম শিক্ষক’ হওয়া 
“বালককে যে পথে চালাতে হবে, সেই পথে তাকে দীক্ষিত কর,
বার্ধক্যকালেও সে তা ছাড়বে না।” (প্রবচন ২২: ৬)
সন্তান যে পথে যাবে, সে পথ চিনিয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। স্কুল বা সরকারের নয়, সকল বাবারই তা দায়িত্ব।
২. বাবার উত্তম জীবন যাপন করা উচিত 
“না, তোমরাই আমাদের সুপারিশ-পত্র, যা আমাদের হৃদয়ে লেখা, যা সকলেই দেখতেও পায়, পড়তেও পারে।” (২ করিন্থীয় ২: ৩)
ঐশবাণী আমাদের বলে দেয় আমরা কে, এবং কিভাবে আমরা ‘ঈশ্বরের লেখা পত্র’। আমাদের সন্তানেরা প্রতিদিনই এই পত্র পড়ে।
৩. পরিবারকে যুগিয়ে দেয়া
“কোন লোক যদি তার আত্মীয়-স্বজন আর বিশেষ করে তা’র নিজের ঘরের মানুষদের ভরণ-পোষণ না করে, তার মানে, সে খ্রিস্টবিশ্বাসের পথ ছেড়েই দিয়েছে; সে তো অবিশ্বাসীরও অধম!” (১ তিমথি ৫: ৮)
বাবার দায়িত্ব হচ্ছে পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা। যাদের কাজ নেই, ভেঙ্গে না পড়ে তাদের কাজ পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আর্থিকভাবে কঠিন হলেও পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর সৎ উপায় বের করা আবশ্যক।
৪. ভাল বাবা সন্তানদের শাসন করে
“লাঠি যে কম ব্যবহার করে, সে সন্তানকে ঘৃণা করে;
কিন্তু তাকে যে ভালবাসে, সে তাকে শাসন করতে তৎপর।” (প্রবচন ১৩: ২৪)
যে বাবা তার সন্তানকে ভালবাসে, ঐশবাণী বলে ‘সে তাকে তাকে শাসন করতে তৎপর’। এটি আমাদের বাড়ীতে উৎসাহী নেতৃত্বকে প্রকাশ করে।
৫. বাবা তার সন্তানদের সাথে সময় কাটান, এবং তা অযথা বা উদ্দেশ্যবিহীন নয়
“এই যে সকল বাণী আমি আজ তোমার জন্য জারি করি, তা তোমার হৃদয়ে স্থির থাকুক। তা তুমি তোমার সন্তানদের বারবার বলবে, এবং ঘরে বসে থাকার সময়ে, পথে চলার সময়ে, শোয়ার সময়ে ও ওঠার সময়ে এ সম্বন্ধে কথা বলবে।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৬: ৬-৭)
পবিত্র শাস্ত্র স্পষ্টভাবেই বলে, বাবারা যেন সন্তানদের সাথে গভীর ও হৃদয়পূর্ণভাবে কথা বলে, প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়। সন্তানদের সাথে নিয়মিত হেঁটে হেঁটে কথা বলার জন্য কিছু সময় রাখা যায়। এই পারিবারিক মুহূর্তগুলো অনেক মূল্যবান।
৬. স্নেহময়তা বাবার বৈশিষ্ট্য
“পিতা তাঁর পুত্রকে যেমনটি স্নেহই করেন, ভগবানও ভক্তের প্রতি তেমনি স্নেহময়।” (সাম ১০৩: ১৩)
৭. সন্তানকে ভর্ৎসনা না করা
“আর তোমরা, পিতারা, তোমরা কিন্তু তোমাদের সন্তানদের রাগিয়ে তুলো না; বরং প্রভুরই শিক্ষা ও শাসনের আদর্শে তাদের মানুষ ক’রে তোল।” (এফেসীয় ৬: ৪)
ভর্ৎসনা না করে ঈশ্বরের শিক্ষা ও শাসনের আদর্শে সন্তানকে বিশ্বাসে বড় করে তোলাই বাবার দায়িত্ব।
৮. সন্তানের ব্যাপারে পিতা হাল ছেড়ে দেয়না
‘অপব্যয়ী পুত্রের গল্প’ (লুক ১৫: ২০-২৪) এমন একজন বাবার গল্প, যিনি কখনোই আশা জেড়ে দেননা এবং সন্তানকে যে কোন সময়ে বুকে টেনে নিতে প্রস্তুত। আমরা সন্তানকে শাসন করতে পারি, জবাবদিহিতা আশা করতে পারি, কিন্তু কখনোই হাল ছেড়ে দেয়া ঠিক না।
৯. বাবা তার সন্তানদের জন্য প্রার্থনা করেন
“আর আমার ছেলে সলোমনকে একনিষ্ঠ হৃদয় প্রদান কর, যেন সে তোমার আজ্ঞা, তোমার সুব্যবস্থা ও তোমার বিধি- নিয়ম পালন করতে পারে, এবং যে প্রাসাদের জন্য আমি ব্যবস্থা করেছি, সে যেন তা গেঁথে তুলতে পারে।” (২ বংশাবলি ২৯: ১৯)
রাজা দাউদ যেভাবে সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছেন, সেভাবে সন্তান যদি নিঃসন্দেহ হয় যে তার বাবা তার জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করে, তাহলে সন্তানের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালবাসা ও নিরাপত্তা।
মাতার দায়িত্ব সম্পর্কে ঐশবাণী কি বলে?
১. মা সদ্বিবেচনা সম্পন্ন 
“সদ্বিবেচকের হৃদয় সদ্জ্ঞান অন্বেষণ করে।” (প্রবচন ১৫: ১৪)
ভাল খ্রিস্টান মা ঈশ্বরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে এবং তার হৃদয় হয় সদ্বিবেচনাপূর্ণ। ঐশবাণী পাঠে প্রজ্ঞা বাড়িয়ে তুলতে সে চেষ্টা করে এবং ঐশবিশ্বাসী মা হয়ে ওঠার সাধনা চালায়। ঈশ্বর মায়ের সদ্বিবেচনা সন্তানদের জীবনে দান করেন যাতে করে তারা ন্যায়পরায়ণ হয়ে বেড়ে ওঠে।
২. মা প্রার্থনায় বিরামহীন 
“… সর্বদাই প্রার্থনা করে যাওয়া উচিত, কখনো নিরাশ হয়ে পড়া উচিত নয়” (লুক ১৮: ১)
একজন বিশ্বাসী মা সবসময়ই সন্তানদের প্রার্থনায় স্মরণ করে, এমনকি কেউ যদি বিপথগামী হয় তবুও। যতদিন একজন মা বেঁচে থাকে ততদিনই সে তার সন্তানদের জীবনে মঙ্গল ও দয়া চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। এই মায়েরা পবিত্র আত্মার প্রেরণায় সন্তানদের জন্য বিরামহীন প্রার্থনা করার উৎসাহ পায়, লেগে থাকে।
৩. নিংস্বার্থ ভালবাসার প্রকাশ
“ভালবাসার মধ্যে কোন ভয় থাকতেই পারে না, বরং পূর্ণ ভালবাসা ভয়কে দূরে সরিয়ে দেয়!” (১ যোহন ৪: ১৮)
যে মা হৃদয় দিয়ে ঈশ্বরকে ভালবাসে সে তার সন্তানকে নিংস্বার্থ ভালবাসা দিতে ভয় করেনা। সে জানে যে, তার ধৈর্য্য শক্তির পরীক্ষায় সন্তানের অবাধ্যতা অভিজ্ঞতা করবে, কিন্তু তা কখনোই তার ভালবাসাকে রাগে রূপান্তরিত করবে না। তার ভালবাসা সন্তানের মধ্যে এমন আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় যে তারা জানে খারাপ আচরণের জন্যও তারা কখনোই মায়ের ভালবাসা হারাবে না।
৪. আনন্দদায়ক মুহূর্ত সৃষ্টি করা
“আনন্দের পূর্ণতা তোমারই সান্নিধ্যে” (সাম ১৬: ১১)
যে কেউ ঈশ্বরবিশ্বাসী মায়ের গৃহে প্রবেশ করে আনন্দের উপস্থিতি অনুভব করবে। ঈশ্বর বিমুখ জগতে বসবাসের তিক্ততার মধ্যেও তার গভীরে প্রোথিত আনন্দ টিকে থাকে। প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দ অনুভব করতে সে তার সন্তানদের জীবন দিয়ে শিক্ষা দেয়।
৫. ঐশবাণীর প্রতি দৃঢ় নির্ভরতা
“যে পথে তাদের নিয়ত চারণা, তারাই বিজ্ঞজন” (সাম ১১১: ১১)
খ্রিস্টবিশ্বাসী মা পরিবারের যে কোন সমস্যায় ঐশবাণী’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। সে নিয়মিত ঐশবাণী অনুধ্যান করে এবং সন্তানকে তা বলে ও শিক্ষা দেয়। তার পরিবার তার অধ্যবসায় অভিজ্ঞতা করে এবং নিজেদের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় ঐশবাণীর শিক্ষা অনুসরণের শিক্ষা পায়।
৬. অন্যের অপরাধ স্বেচ্ছায় ক্ষমা করা
“তোমরা যদি কারও পাপ ক্ষমা কর, তবে তা ক্ষমা করাই হবে” (যোহন ২০: ২৩)
পরিবারের কেউ বা পরিবারের বাইরের কেউ অপরাধ করতে পারে। কিন্তু ঈশ্বরভক্ত মা তার মন ভাল হওয়া পর্যন্ত অপরাধ ধরে রাখে না, বরং সাথে সাথে ক্ষমা করে এবং বিশ্বাস করে পবিত্র আত্মা তার হৃদয়ে প্রলেপ দেবে। তার পরিবারের সদস্যরা তার এই আদর্শ দেখে অনুপ্রাণিত হয় এবং অপরকে ক্ষমা করা জীবনের অংশরূপে গ্রহণ করে।
৭. তৃপ্ত থাকার অভ্যাস
“আর সত্যি সত্যিই ধর্মপালনে তো বিরাট লাভই হয়- অবশ্য শুধু তাদেরই, যারা নিজের যা আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে।” (১ তিমথি ৬: ৬)
সন্তান, স্বামী, অন্যান্য বিষয় নিয়ে ঈশ্বরভক্ত মা অতৃপ্ত হওয়ার বাসনা রোধ করে। সে জানে জাগতিক বিষয় ও অর্থের পেছনে ছুটেই শান্তি পাওয়া যায়না। বরং সে তার সকল প্রয়োজন মেটার বিষয়ে সে ঈশ্বরের উপরে নির্ভর করে এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে সবকিছু ছেড়ে দেয়।
৮. ঈশ্বরে দৃঢ় বিশ্বাস
“যারা জেনেছে তোমার নাম, তারা তোমাতেই আস্থা রাখুক, ওগো ভগবান; তোমার অন্বেষী যারা, তুমি তো তাদের ত্যাগ কর না কখনো।” (সাম ৯: ১০)
মায়ের ঈশ্বর বিশ্বাস তখনই বেশী প্রকাশিত হয় যখন সে জীবনের চরম মূহূর্তগুলো অতিক্রম করে। অন্যান্য বিশ্বাসীদের মত খ্রিস্টবিশ্বাসী মা-ও বিপদের সময়ে নিজের জীবনে ঈশ্বরের কাজ নিয়ে সন্দিহান হতে প্রলোভন পায়, তদুপরি সে নিজের এবং নিজের পরিবারের যত্ন নিতে দৃঢ় থাকে। ঈশ্বরের সাথে তার একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরী হয় যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতেই থাকে।
৯. বিশ্বস্ত থাকা
“বিশ্বস্ত মানুষ অনেক আশীর্বাদের পাত্র হবে” (প্রবচন ২৮: ২০)
স্ত্রী এবং মা হিসেবে নিজের ভূমিকায় মা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। বিশ্বাস চর্চাকে ঈশ্বরভক্ত মা গ্রহণ করে যাতে করে সে আরো অধ্যবসায়ী হয়ে বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বর ও মানুষের সাথে তার পরিপক্ক সম্পর্ক তার বিশ^স্ততায় প্রকাশিত হয়।
১০. পারিবারিক ঝামেলা শান্ত করে
“বাড়ির সকলের আচরণের দিকে সে লক্ষ্য রাখে, তার অন্ন অলসতার ফল নয়।” (প্রবচন ৩১: ২৭)
খ্রিস্টবিশ্বাসী মায়ের অলসতা বিমুখতা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তার মূল মনযোগের বিষয় সাজানো গোছানো প্রাচুর্যপূর্ণ বাড়ী নয়, বরং একটি স্বাস্থ্যকর পরিবার যেখানে আছে ভালবাসা, হাসি এবং পারস্পরিক সম্মান। মাত্র শারীরিক ঝামেলা থেকে নয় বরং জাগতিকতার মাঝে আধ্যাত্মিক ও মানসিক অশান্তি থেকেও সে তার পরিবারকে মুক্ত রাখে।
১১. যা সঠিক তার পক্ষালম্বন
“সেদিন ধার্মিকেরা তাদের পিতার সেই রাজ্যে সূর্যের মতই দীপ্তিমান হয়ে উঠবে।” (মথি ১৩: ৪৩)
পরিবারের সন্তানদের বিপথগামী স্বভাবের মুখে ঈশ্বরভক্ত মা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও সক্ষম হয়। সন্তানের আধ্যাত্মিক, মানসিক ও শারীরিক উত্তমতার জন্য যা কিছু ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সঠিক ও ন্যায় তাতেই সে তার সিদ্ধান্ত ন্যস্ত করে। শুধুমাত্র সমঝোতার উদ্দেশ্যে সে যা কিছু সঠিক তা থেকে সরে আসে না।
১২. ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সন্তানকে ছেড়ে দেয়া
“… আশা তো কখনো ছলনা করে না” (রোমীয় ৫: ৫)
খ্রিস্টবিশ্বাসী মা তার সন্তানদের হৃদয়ে লালন করে, কিন্তু নিজের মত করে ঈশ্বরে বেড়ে উঠতে তাদের আবার ছেড়েও দেয়। সে প্রার্থনা করে ও সন্তানকে ঈশ্বর রক্ষা করবেন ও তার জীবনে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। ভবিষ্যত নিয়ে নিজের স্বপ্ন ও পরিকল্পনার চাইতে সে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে বেশী মনযোগী হয়।
নাজারেথের পুণ্য পরিবার আমাদের সকল খ্রিস্টিয় পরিবারের আদর্শ। পুণ্য পরিবারের আদর্শগুলো অনুধ্যান করে নিজ পরিবারে সেইমত গুণবলী অনুশীলণের চর্চা, পরিবারে নিয়মিত ঐশবাণী পাঠ ও প্রার্থনা এবং ঐশবাণীর শিক্ষা অনুসারে বাবা ও মা হিসেবে পরিবারকে চালনা করার মাধ্যমে ঐশবাণী কেন্দ্রিক পরিবার হিসেবে গড়ে ওঠা ঈশ্বরের বিশেষ কৃপা ও আশীর্বাদ। আমরা কেউই এই কৃপা অর্জন করতে পারি না। আমাদের ক্রমাগত সাধনায় পরমেশ্বর সহায় থাকুন, পবিত্র আত্মা আমাদের পরিচালনা দান করুন। নাজারেথের পুণ্য পরিবার: আমাদের মঙ্গল প্রার্থনা করো।

Leave a Reply